সদ্য ঘুরে এলাম গোয়া সমুদ্র সৈকতের বেশ কয়েকটি জায়গায় ও বীচে। গোয়ার সাথে ছিল কেরালা, কোচিন আর মুন্নার ভ্রমণ। এই পুরো ভ্রমণে আমরা ৩ জন, ১৩ দিনে, ঢাকা থেকে ঢাকা নানা রকম ট্রেন ও বাসে জার্নি করেছি প্রায় ৮,০০০ কিলোমিটার আর তিন জনের একক পরিবারের খরচ হয়েছিল ৫৩-৫৫ হাজার টাকা। কেরালা আর মুন্নারের গল্প পরে হবে।
আজকে শুধু গোয়া পর্যন্ত যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া, গোয়ার সৈকতগুলোতে যাতায়াত আর অন্যান্য খরচের কথাই বলবো। যেহেতু এই খরচেই সবার যত আগ্রহ আর হ্যাঁ রুট, সময় এবং টিকেটও একটা বেশ বড় ইস্যু। তো শুরু করা যাক, কোথায়, কীভাবে আর কত খরচে শুধু গোয়া ঘুরে আবার ঢাকার ফিরে আসা যায় সেই গল্প, অবশ্যই আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে।
খোঁজ নিয়ে জানলাম কলকাতা থেকে গোয়াতে মাত্র একটাই ট্রেন ছেড়ে যায়। সেটাও প্রতিদিন না, সপ্তাহে তিন বা চারদিন। যে কারণে কলকাতা থেকে গোয়া যাবার অমরাবতী এক্সপ্রেসের নন এসি স্লিপার ক্লাসের টিকেট কেটেছিলাম তিন জনের জন্য প্রায় চারমাস আগে, যাওয়া আর আসার ঝামেলা না রাখতে। নন এসি স্লিপার ক্লাসের টিকেটের দাম ভারতীয় ৭৫০ রুপী। কিন্তু আমি ১,৩০০ টাকা করে কিনেছিলাম এখানে বসেই। এসি-৩ আর এসি-২ও আছে, সেগুলোর ভাড়া ২,৫০০-৪,০০০ এর মতো। যেটা আমার একার প্রায় পুরো ট্রিপের বাজেট!
আর প্লেনের খোঁজ নিয়ে দেখেছিলাম বাংলাদেশী টাকায় ৯-১০ হাজারের নিচে গোয়ার টিকেট পাওয়া যায় না ওয়ান ওয়েতেই! বোথ ওয়ে করলে একটু কম পড়ে। সেটাও নির্ভর করে কত আগে টিকেট করবেন তার উপরে।
নির্ধারিত ভ্রমণের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যাওয়া নিয়ে নানা রকম অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও রাত ১১টার বাসে ঢাকা থেকে বেনাপোল গিয়েছিলাম রয়েলের ইকোনমিক ক্লাস এসিতে। ভাড়া নিয়েছিল ১,০০০ টাকা করে। ঠিক সকাল ৬টায় নেমেছিলাম বেনাপোল বন্দরে।
ইমিগ্রেশনে ফ্রেস হয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত পেরিয়েছিলাম বেশ আরামেই। কিন্তু ওপারের সীমান্তে গিয়ে বিশাল লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল সেই সকালেই! প্রায় ১ ঘণ্টারও বেশি সময় পরে ওপারের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে একটু চা খেয়ে অটোতে করে বনগাঁ জনপ্রতি ৩০ রুপী ভাড়া।
বনগাঁ থেকে ২০ রুপী করে বনগাঁ লোকালের টিকেট কেটে স্টেশনে বসে নাস্তা সেরে নিলাম তিনজনে মিলে। ট্রেন থেকে নেমে সোজা চলে গেলাম ১২০ রুপী ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে ফেয়ারলি প্যালেস। ৫ মে ঢাকায় ফেরার ট্রেন টিকেট করে রাখতে। কারণ সেই সময় প্রায় ঈদের ছুটি থাকবে, কোনো টিকেট পাওয়া যাবে না। কী যে ভালো করেছিলাম এত আগে আগে টিকেট করে, সেটা ফেরার সময় অনুভব করেছি।
ওদেরকে ফেয়ারলি প্যালেসের এসিতে বসিয়ে রেখে আমি বড় লাগেজ দুটো নিয়ে চলে গেলাম হাওড়া স্টেশনে। কারণ আমাদের ট্রেন সেই রাত প্রায় ১২টায় (ভারতীয় সময় ১১:৩০টায়) আসবে। এত লম্বা সময় বিশাল ভারী (তিন জনের ১৩ দিনের কাপড়) দুটো ব্যাগ টানার কোনো মানেই হয় না। ওগুলো হাওড়া স্টেশনের লকারে চালান করে দিয়ে হালকা হলাম (লকারের ব্যাগ রাখার জন্য ট্রেন টিকেট, পাসপোর্ট বাধ্যতামূলক) ৩০ রুপীর বিনিময়ে। উদ্দেশ্য কলকাতা সারাদিন ঘুরে, কাজ করে রাতে ট্রেন ওঠার আগে প্লাটফর্মে গোসল করে ব্যাগ লকার থেকে নিয়ে নেব। ঝামেলাহীন থাকা যাবে সারাদিন।
ব্যাগ রেখে ফেরী পার হয়ে ওদেরকে ফেয়ারলি প্যালেস থেকে নিতে গিয়ে দেখি তখনও টিকেট দেয়নি। আরও প্রায় ১৫ মিনিট অপেক্ষার পরে ১,৩৪০ রুপী করে মৈত্রী ট্রেনের টিকেট নিয়ে, ট্যাক্সি করে নিউমার্কেট এরিয়ায় চলে এলাম। যাই হোক, সারাদিনের কাজ সেরে, সন্ধ্যার পরে কেএফসি থেকে ১১৫ রুপীর রাইস মিল পার্সেল নিয়ে হাওড়া গিয়ে, সবাই মিলে ১০ রুপী জনপ্রতি দিয়ে গোসল করে, খেয়ে দেয়ে, লকার থেকে ব্যাগ তুলে নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম।
দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চললেও উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক হয়ে ৪ ঘণ্টা লেটে ৪৪ ঘণ্টায় গোয়া পৌঁছালাম সন্ধ্যা প্রায় ৬টায়! ট্রেনের দুই দিনে আমরা বিভিন্ন স্টেশন থেকে রুটি, পরোটা, ডিম বিরিয়ানি আর চিকেন দিয়ে সকাল, দুপুর আর রাতের খাবার খেয়েছিলাম। তাতে করে তিন জনের দুই দিনে ১,০০০ রুপীর মতো খরচ হয়েছিল পানীয়সহ।
আর এই দীর্ঘ জার্নির কারণে ততক্ষণে আমার কথা বাদ ছেলে আর তার মায়ের অবস্থা কাহিল প্রায়। তাই দেরি না করে আর দূরের কোনো বীচে না গিয়ে ৫/৬ কিলোমিটার দূরের কোলভা বীচের কাছে হোটেল বীচ রিসোর্টে একটি এসি রুম নিলাম ১,৫০০ রুপী করে। সাথে সুইমিংপুলের সুবিধাসহ।
সবকিছু ভালো লেগে যাওয়ায় আর অন্য কোথাও ছোটাছুটি না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ওখানেই থেকে গিয়েছিলাম পরের চারদিন। এই হোটেলের খাবারটা আমাদের দারুণ লেগেছিল। একটা ছোট আকারের (৩০০ গ্রাম) রূপচাঁদা মাছের ভাজা, একটা সামুদ্রিক মাছের ঝোল আর একজনের জন্য পর্যাপ্ত ভাতের প্যাকেজ ১০০ রুপী! ব্যস, এই আমাদের জন্য দারুণ হয়েছিল, বাজেট, স্বাদ আর পরিমাণের সমন্বয়ে।
প্রথমদিন সন্ধ্যায় আমরা কোলভা বীচে হেঁটে, বসে আর আরাম করে কাটিয়েছিলাম। পরেরদিন তুখোড় রোদের কারণে সকালে বীচে না গিয়ে হোটেলের নীল জলের ঠাণ্ডা সুমিং পুলে ভেসে ভেসে কাটিয়ে দিয়েছিলাম। দুপুরে ভাতঘুম দিয়ে উঠে শেষ বিকেলে আবার গিয়েছিলাম বীচে, ছিলাম অনেক রাত পর্যন্ত। রাতের খাবার খেয়েছিলাম বীচ আর হোটেল থেকে বেশ কিছুটা দূরে হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে অ্যারাবিয়ান একটা রেস্টুরেন্টে। ১১০ রুপী করে চিকেন ফ্রাইড রাইস দিয়ে। সাথে ৪০ রুপীর একটি ঠাণ্ডা বিয়ার নিয়ে ফিরছিলাম চুমুক দিতে দিতে।
পরের দিন। ৩০০ টাকা করে জনপ্রতি এসি গাড়ির টিকেট করেছিলাম, যেটা হোটেল থেকে ছেড়ে সারাদিনে বেশ কয়েকটা স্পট, বীচ, ডলফিন পয়েন্ট, ফোর্ট আর আইসল্যান্ড ঘুরিয়ে, সন্ধ্যায় ক্রুজ সাফারি করিয়েছিল। জার্নিটা ছিল দারুণ। তিন জনের এসি শেয়ার গাড়ির ভাড়া পড়েছিল ৯০০ রুপী, যেটা ছোট্ট গাড়ি রিজার্ভ করতে হলে লাগতো ৩,০০০-৩,৫০০ রুপী। আর যেসব স্পটে ঢোকার বা রাইড উপভোগ করার জন্য বাড়তি টিকেট কাটতে হয় সেটা নিজেদের করতে হয়েছিল।
যেমন ডলফিন পয়েন্টের গভীর সমুদ্রে যেতে বোটে করে জনপ্রতি খরচ হয়েছিল ৩০০ রুপী করে। যদিও আমার কাছে টাকার তুলনায় সময়টা বেশ অল্প মনে হয়েছে, কিন্তু অভিজ্ঞতা, রোমাঞ্চ আর নতুন কিছু দেখার কারণে সেটা উসুল হয়ে গিয়েছিল।
আর আমার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও সেই একই রকম ৩০০ রুপী করে জনপ্রতি দিয়ে ১ ঘণ্টার ক্রুজ সাফারি করেছিলাম ছেলে আর তার মায়ের ইচ্ছায়। একেবারেই ওয়েস্টার্ন স্টাইলের নাচ-গান আর ব্যাপার স্যাপার। পরিবার নিয়ে তেমন একটা উপভোগ করা যায় না! এসব একা বা ব্যাচেলর হয়ে ভালো করে উপভোগ করা যায়।
সারাদিনের নানা জায়গায় ভ্রমণ শেষে হোটেলে ফিরেছিলাম রাত ৯টায়। দারুণ চমৎকার ছিল পুরো ভ্রমণটা। চার-পাঁচটি একদম অচেনা পরিবারের একদিনের জন্য বেশ কাছাকাছি হয়ে যাওয়া, রাতে বিদায় বেলায় আবার যার যার তার তার। অনেক মজার একটা ব্যাপার ছিল।
পরের দিন সাউথ গোয়াতে একই রকম প্যাকেজ ছিল। কিন্তু আমরা হেঁটে হেঁটে পুরনো গোয়া দেখার পক্ষে ছিলাম। আর ছিল কিছু কেনাকাটার ব্যাপার। আর তাছাড়া সন্ধ্যায় আমাদের কেরালার ট্রেন আছে। তাই একটু তাড়াতাড়ি স্টেশনে পৌঁছে আরাম করার জন্য সেদিন আর কোথাও যাইনি।
শেষ দুপুরে হোটেল থেকে বেরিয়ে ১৫০ রুপীর অটো নিয়ে গিয়েছিলাম কেএফসিতে। হেলেদুলে কেএফসিতে বসে সময় কাটিয়ে, ১১৫ রুপীর রাইস মিল নিয়ে তিনজন মিলে শেষ বিকেলে ১০০ রুপী অটো ভাড়ায় চলে গেলাম স্টেশনে। চমৎকার ঝকঝকে স্টেশনে সমান্তরাল ব্রিজের উপরে বসে রইলাম আমাদের কেরালা যাবার ট্রেন আসার পূর্ব পর্যন্ত। এই ছিল আমাদের চারদিনের গোয়া ভ্রমণ আর খরচের বিস্তারিত।
এবার একটু দেখে নেই ঢাকা থেকে গোয়া গিয়ে, চারদিন থেকে খেয়ে আর একই রকমভাবে ফিরে আসতে আমাদের কত খরচ হয়েছিল আর জনপ্রতি কত? সকল হিসেব টাকায় কনভার্ট করে দেয়া হলো।
মিরপুর থেকে কল্যাণপুর সিএনজি ১৫০/-
ঢাকা থেকে বেনাপোল বাস ২,০০০/- (দুই সিট)
অটোতে বনগাঁ স্টেশন ১১০/-
বনগাঁ লোকালে শিয়ালদহ ৭৫/-
শিয়ালদহ থেকে ফেয়ারলি প্যালেস ১৯০/-
ফেয়ারলি থেকে নিউমার্কেট ১০০/-
নিউমার্কেট থেকে হাওড়া ২১০/-
হাওড়া-গোয়া ট্রেন ৩,৯০০/-
দুইদিন ট্রেনে খাওয়া ১,৬০০/-
স্টেশন থেকে হোটেল ৩৫০/-
হোটেল ভাড়া তিনদিন ৬,০০০/-
নর্থ গোয়া ভ্রমণ ৩,৫০০/-
চারদিনের খাওয়া ৩,০০০/-
স্টেশনে যাওয়া ৩৫০/-
মোট ২১,৫৩৫/-
জনপ্রতি ৭,১৭৮/- টাকা।
আর যদি একইভাবে ফিরে আসার ট্রেন টিকেট হিসেব করেন তবে ৭,১৭৮+১,০০০= ৮,১৭৮/-
তবে এই খরচ তো আমাদের পারিবারিক হিসেব অনুযায়ী। কিন্তু কেউ যদি একা বা ব্যাচেলর গ্রুপ করে যেতে চান, সেটা কিন্তু আরও দেড় থেকে দুই হাজারে কমিয়ে আনা সম্ভব। যদি ডরমেটরিতে ২৫০ বা ৩০০ টাকা করে থাকেন, অথবা ৬০০-১,০০০ টাকার নন এসির এক রুমে তিনজন থাকেন। লোকাল বাসে করে ৫০ রুপিতেই সাউথ থেকে নর্থ বা নর্থ থেকে সাউথে যেতে পারবেন। অথবা ৩০০ রুপী দিয়ে দুজনে মিলে একটা বাইক বা স্কুটি নিয়ে সারা গোয়ার সম্ভাব্য সব বীচ ঘুরে ঘুরে দেখতে পারেন।
মোট কথা, একজনের সাকুল্যে ৬,০০০-৮,০০০ টাকায় হয়ে যাবে নন এসি স্লিপারের ট্রেন টিকেট, গ্রুপ করে ডরমে থাকা আর লোকাল ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করলে। আর গোয়াতে যদি চারদিনের যায়গায় সাত দিন করতে চান, তাহলে এইভাবে ট্র্যাভেল করলে ১০,০০০ যথেষ্ট বলে আমার মনে হয়।
তবে বারবার বলছি ট্রেন টিকেট বেশ আগে থেকেই করে রাখবেন যাওয়া এবং আসার। কলকাতা-গোয়া-কলকাতা বা প্লেনে গেলে প্লেন টিকেট। আশা করছি এই হিসেব সবার কমবেশি কাজে লাগবে।