সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভূস্বর্গ কাশ্মীর সম্পর্কে জানা ও দেখার ইচ্ছা সেই স্কুল জীবন থেকে। বইয়ের পাতায় কাশ্মীরের দৃষ্টিনন্দন নৈসর্গিক নয়নাভিরাম শোভার বর্ণনা পড়ে মুগ্ধ হতাম আর মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম আহ! যদি চোখে দেখতে পারতাম অপরূপ কাশ্মীর। ছোট বেলার সেই স্বপ্ন পূরণ হলো গত মাসে।
কাশ্মীর অনেকগুলি নামে পরিচিত। যেমন- ঋষিভূমি, যোগীস্থান, শারদাপীঠ বা শারদাস্থান ইত্যাদি। তবে সম্রাট জাহাঙ্গীরের দেয়া ‘ভূস্বর্গ’ নামটিই সবচে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কাশ্মীরকে বলা হয় সুখী উপত্যকা।
পুরাকাল থেকেই কাশ্মীরের কাহিনী শুনে আসছে জনগণ।
মহাভারতে কাশ্মীরের আখ্যান মেলে। ধারণা করা হয় অতীতে কাশ্মীর ছিল জলমগ্ন। জম্মু ও কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগর। শীতকালের রাজধানী জম্মু। ডাল লেক এবং ঝিলাম নদী শ্রীনগরের দুই হৃৎপিণ্ড। ১ হাজার ৭শ’ ৬৮ মিটার উঁচুতে প্রায় ১শ’ ১৪ বর্গ কিলোমিটার উপত্যকা জুড়ে লেক ও বাগিচায় সুশোভিত আধুনিক শহর শ্রীনগর। আর ঝিলাম নদীর উত্তর-পশ্চিম এলাকা জুড়ে শহর। শহরের জনসংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। শ্রীনগর থেকেই মূলত পর্যটকদের ভ্রমণ তালিকা তৈরি হয়।
শীতপ্রধান কাশ্মীরের নারী-পুরুষ সকলেই আলখাল্লা পরিধান করে। যাকে বলা হয় ফেরণ। এটি উলের কাপড়ে তৈরি হয়। শ্রীনগরের অন্যতম আকর্ষণ কাশ্মীর সুন্দরী ডাল লেক। লাকুতি ডাল, গাগরিবাল, বড়া ডাল ত্রয়ীর সমন্বয়ে ডাল লেক। পাশেই নাগিন। এটি ডালের অংশ হলেও ভাসমান উদ্যান এটিকে পৃথক করেছে। এই ডালকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে পর্যটকদের জন্য বিনোদন কেন্দ্রগুলো। ডালের গভীরতা দেড় থেকে ৬ মিটার।
অতীতে ব্রিটিশদের কাশ্মীর ভূখণ্ডে স্থান দেয়া হতো না। তখনই ব্রিটিশরা পানিতে বাস করার জন্য বড় বড় নৌকায় থাকতো। এগুলোর নাম ‘হাউজ বোট’। ডাল লেক-এর কারণেই শ্রীনগরকে বলা হয় প্রাচ্যের ভেনিস। পারের সঙ্গে সংযোগ রাখতে ছোট ছোট বোট ব্যবহার হয়। যার নাম শিকারা। ডাল লেকের ডান পার বরাবর অনেক আবাসিক হোটেল। ডালের দক্ষিণে শঙ্করাচার্য এবং পূর্ব দিকে হরি পর্বত যেন প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর পশ্চিমে বিখ্যাত হযরতবাল মসজিদ। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া হাউজবোটই এখন পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। কাশ্মীরের শ্রীনগর এসে হাউজবোটে রাত কাটানো ভ্রমণে নিয়ে আসে বৈচিত্র্যের স্বাদ। হাউজ বোটে রাত না কাটালে যেন কাশ্মীর ভ্রমণই বৃথা।
কাশ্মীরকে পৃথিবীর স্বর্গ বলা হয়। কেন স্বর্গ বলা হয়-নিজ চোখে না দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন না। অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন কাশ্মীর অনেক দূর, অনেক খরচের ব্যাপার এবং যুদ্ধপ্রবণ এলাকা। এজন্য যাওয়া ঠিক হবে না। কথাটা একেবারেই মিথ্যা নয় আবার পুরোপুরি সত্যি তাও না। কাশ্মীর অনেক দূর এটা ঠিক কিন্তু এর থেকেও দূরে তো আপনি ভ্রমণ করতে যান তাই না?
কাশ্মীর বর্ডার থেকে ট্যুরিস্ট স্পটগুলো মোটামুটি ৩শ’ থেকে ৪শ’ কিলোমিটার দূরে। সুতরাং আর দেরি না করে আপনি নির্ভয়ে বেরিয়ে পড়ুন কাশ্মীরের উদ্দেশে।
আপনাদের জন্য পুরো কাশ্মীর ট্যুর প্ল্যান ও কাশ্মীর ভ্রমণে কত খরচ পড়তে পারে তা তুলে ধরা হলো। তবে চলুন আর দেরি নয় কাশ্মীর ঘুরে আসি।
শুরুতেই আপনি এক হাজার ৮শ’ টাকা দিয়ে সোজা কলকাতার বাসের টিকেট কিনে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিতে পারেন। পথিমধ্যে হালকা স্ন্যাকস খেয়ে নিতে পারেন। খরচ পড়বে ১শ’ টাকা। সকালে বেনাপোল বর্ডারে নাস্তা খেয়ে নিতে পারেন ১শ’ টাকার মধ্যে। সব মিলিয়ে মোট খরচ হবে দুই হাজার টাকা। এরপর কলকাতা পৌঁছে একটি হোটেলে দিন হিসাবে ‘চেক ইন’ করতে পারেন ৫০০ রুপি দিয়ে। দুপুরের খাবার খান ২শ’ রুপির ভেতরেই। রাতের জন্যও একই রকম ২শ’ রুপি। জম্মু যাওয়ার ট্রেনে ভাড়া পড়বে এক হাজার ৯শ’৭০ রুপি। এই হিসাবে আপনার খরচ হলো দুই হাজার ৮শ’৭০ রুপি।
এরপর সারাদিন ট্রেনে। খাবার খান, ৫শ’ রুপির মধ্যে। এরপর আপনি জম্মু পৌঁছাতে পারেন। সকালের নাস্তা ১শ’ রুপি। দুপুর ও রাতের খাবার ৪শ’ রুপি। গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারেন শ্রীনগরে। মোট খরচ ৫শ’ রুপি।
শ্রীনগরের হোটেল এবং গাড়ির ভাড়া নিয়ে পরে কথা হবে। সময় পেলে সোনমার্গ ঘুরতে যেতে পারেন। দুপুরের খাবার ২শ’ রুপি। আপনার ভাগ্য যদি ভালো হয় তাহলে সোনমার্গে পৌঁছে আপনি অঝোর ধারায় তুষারপাত দেখতে পাবেন। শুরুতেই স্থানীয় একটি দোকান থেকে আপনি হ্যান্ডগ্লাভস কিনে নিতে পারেন। এরপর বরফ মোকাবিলার জন্য মোটা জ্যাকেট ও গামবুট ভাড়া পড়তে পারেন। এরপর লোকাল একটি গাড়ি ভাড়া করে আপনি সোনমার্গের বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুরে আসতে পারেন। ড্রাইভারই নিয়ে যাবে আপনাকে। আপনার কাছে যেগুলো হাতের নাগালে সেগুলোই ঘুরে দেখুন।
এছাড়া গুলমার্গ ঘুরতে যেতে পারেন আপনি। দুপুরের খাবারে খরচ পড়বে ২শ’ রুপি। শ্রীনগর থেকে দ্বিতীয় দিনে আপনি যেতে পারেন গুলমার্গে। গুলমার্গ ঢোকার আগেই আপনার ড্রাইভার আপনার জন্য যথারীতি ড্রেস ভাড়া করার দোকানে নিয়ে যাবে। এখান থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে আপনি রওনা হতে পারেন গুলমার্গের স্পটের উদ্দেশে। গাড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওপরে উঠতে থাকবে। গুলমার্গ ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যাবে আপনার। দূরের সাদা পাহাড়গুলো হাতছানি দিয়ে ডাকবে আপনাকে। নিচের সবুজ ভ্যালি দেখে মনে হয়ে যাবে এখানেই শাহরুখ ‘জাব তাক হে জান’ছবির শুটিং করেছিল। যাই হোক প্রথমে একটি ঘোড়া ভাড়া করে গুলমার্গ ভ্যালি কিছুটা ঘুরে দেখতে পারেন। এরপর রোপওয়ের টিকিট কেটে গোন্ডলায় উঠে বসতে পারেন। ১২-১৩ মিনিট পর পৌঁছাতে পারেন ফ্যাজ ১-এ। যেদিকেই চোখ যায় শুভ্র সাদা আর সাদা।
শ্রীনগর সিটি ট্যুর। দুপুরের খাবারের খরচ পড়বে ভারতীয় ২০০ রুপি। সিটি ট্যুরের প্রথমেই আপনি যেতে পারেন হজরতবাল মসজিদে। কথিত আছে এখানে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চুল সংরক্ষিত আছে। ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন একটা শান্তির অনুভূতি শরীরে দোলা দেবে। মসজিদটা খুবই সুন্দর। এর পেছন দিকের লেকটি তো আরো সুন্দর। কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগবে এর বাইরের পায়রাগুলো। ওদের খাওয়ানোর কথা কিন্তু ভুলবেন না আপনি। এরপর আপনি যেতে পারেন নিশাদ বেগ পার্কে, এরপর শালিমার বেগ পার্কে তারপর বোটানিক্যাল গার্ডেন। হয়তো আপনি ভাবছেন এসব গার্ডেনে কী আছে এমন। আপনি শুধু ভাবুন, গার্ডেনের সবগুলো গাছের পাতার রং যদি বিভিন্ন রকম হয় তাহলে কেমন অনুভূতি হবে আপনার!
এবার ঘুরে আসতে পারেন পাহেলগাম থেকে। ব্রেকফাস্ট করেই আপনি বের হতে পারেন পাহেলগাম এর উদ্দেশে। লাঞ্চের পর একে একে ঘুরতে পারেন আরু ভ্যালি, বেতাব ভ্যালি, চন্দন ওয়ারী। পাহেলগামের সৌন্দর্যই এই ভ্যালিগুলো। এতো সাজানো-গুছানো যে চোখ জুড়িয়ে যাবে আপনার। আরু ভ্যালির পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা জীবনের অন্যরকম অভিজ্ঞতা হতে পারে আপনার।
ভোর ৬টায় জম্মুর উদ্দেশে রওনা হতে পারেন। একটু একটু করে দিনের আলো ফুটছে আর আপনি বুঝতে পারবেন গাড়ি কিসের ওপর দিয়ে চলছে। সেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬ হাজার ফুট উঁচুতে চলে গাড়ি। ভাবতেই গা শির শির করবে আপনার। সকালের নাশতা পথিমধ্যে খেয়ে নিতে পারেন ১শ’ রুপির মধ্যে। টানা আট ঘণ্টা এ রকম উচ্চতায় চলবে আপনাদের গাড়ি। অবশেষে আরো দুই ঘণ্টা জার্নি করার পর আপনি পৌঁছে যাবেন জম্মুতে। দুপুর ও রাতের খাবাবের জন্য বাজেট ৪শ’ রুপি। এরপর রাতেই কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিতে পারেন।
এরপর সারাদিন ট্রেনে। খাবার বাজেট ৫শ’ রুপি। আপনি এরপর কলকাতা পৌঁছে যাবেন। ক্লান্তি দূর করতে সেখানকার কোনো হোটেলে চেক ইন করতে পারেন। এরপর ঢাকার উদ্দেশে দেশে ফেরা। আপনি যখন বাস থেকে নামবেন তখন আপনার মনটা খারাপ হয়ে যেতে পারে। সত্যি স্বপ্নের মতোই কয়েকটি দিন ছিল আপনার।