ভারতের কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রধানরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বৃহস্পতিবার ঢাকায় এসেছেন। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষাপটে তাদেরকে ঢাকায় আনার উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা ও কৌতূহল দেখা যাচ্ছে।
ঢাকায় আসা এ দুজন কর্মকর্তা হচ্ছেন কলকাতায় বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত উপহাইকমিশনার শিকদার মো. আশরাফুর রহমান এবং ত্রিপুরার আগরতলায় সহকারী হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্বরত আরিফ মোহাম্মদ।
গত দশ দিনের মধ্যে এই দুটি কূটনৈতিক মিশন বিক্ষোভ ও হামলার শিকার হয়।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে এবং সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মুক্তির দাবিতে ২৮শে নভেম্বর কলকাতার উপ-হাইকমিশনের সামনে ‘বঙ্গীয় হিন্দু জাগরণ’ নামে একটি সংগঠন বিক্ষোভ পালন করে। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা ‘সহিংস’ হয়ে পুলিশ ব্যারিকেড ভেঙে উপ-হাইকমিশনের সীমানায় পৌঁছে যায়।
এর পাঁচ দিন পর দোসরা ডিসেম্বর আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, ভাঙচুর ও পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলার ঘটনা ঘটে। ভিডিও ফুটেজে একটি পতাকা পোড়াতেও দেখা যায়।
এসব ঘটনায় বক্তব্য-বিবৃতি দিতে দেখা যায় দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে।
কয়েকদিনের মাথায় ডেকে আনা হলো সংশ্লিষ্ট মিশনগুলোর প্রধানদের।
স্থানীয় কয়েকটি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, কলকাতায় নিযুক্ত ডেপুটি হাই কমিশনার বৃহস্পতিবার বিকেলেই পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সাথে দেখা করেন।
তবে, তাদের ‘প্রত্যাহার করা’ বা ‘ফিরিয়ে আনা হয়েছে’ কি না তা এখনো স্পষ্ট নয়।
দু’টি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে কূটনীতিকদের পদায়ন ও প্রত্যাহারের বিষয়টি নির্ধারিত হয়ে থাকে।
বিভিন্ন কারণে কোনো কূটনীতিককে ‘ফিরিয়ে আনার’ প্রয়োজন পড়তে পারে বলে জানান বাংলাদেশের একজন সাবেক কূটনীতিক মুন্সী ফয়েজ আহমদ।
প্রথমত, কূটনৈতিক মিশনটি যেখানে অবস্থিত সেখানকার পরিস্থিতি যদি বিপজ্জনক হয়ে যায় তাহলে কর্মকর্তাদের ফিরিয়ে আনা জরুরি হয়ে পড়ে।
“তখন পুরো মিশনকেই সাধারণত সরিয়ে আনা হয়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. আহমদ।
এছাড়া, সংশ্লিষ্ট দেশের কোনো কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ স্বরূপ প্রতিনিধি প্রত্যাহার করার কূটনৈতিক রেয়াজ আছে।
ফয়েজ আহমদ বলেন, প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে লেভেল অফ দ্য মিশন ডাউনগ্রেড (অবনমন) করাও একটি চর্চা।
যেমন – কোন হাইকমিশনার বা রাষ্ট্রদূত পদমর্যাদার কর্মকর্তার বদলে ‘চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স’ দিয়ে কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা।
তৃতীয়ত, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের যদি কোনো ব্যর্থতা থাকে তাহলেও ফিরিয়ে আনা বা প্রত্যাহার করা হয়ে থাকে।
“করণীয় ছিল এমন কিছু করতে পারেন নি বা এমন কিছু করেছেন যেটাতে সরকার খুশি নয় সেক্ষেত্রে তাদের ফেরানো হয়,” বলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ফয়েজ আহমদ।
অবশ্য, বাংলাদেশের দুই মিশন প্রধানকে দেশে ডেকে আনার ক্ষেত্রে ওপরের কোনো প্রেক্ষাপটই তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন না মি. আহমদ।
কলকাতার উপ-হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভের ঘটনা এবং আগরতলায় সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনা সম্পর্কে ‘বিস্তারিত আলোচনার’ জন্যই ওই দুই মিশন প্রধানকে ডাকা হয়েছে।
এটি ‘টেম্পোরারি মুভ’ (সাময়িক স্থানান্তর) বলে বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছে ভারতে বাংলাদেশের একটি কূটনৈতিক সূত্র।
এ ধরনের তলব করে কথা বলাকে ‘কনসালটেশন’ (পরামর্শ) হিসেবে অভিহিত করে থাকেন কূটনীতিকরা।
মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, কোনো বিষয় বা ঘটনা সামনাসামনি ভালো করে জেনে নেয়ার জন্য ‘কনসালটেশন’ একটি ‘রুটিন ওয়ার্ক’।
বাংলাদেশের আরেকজন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, মিশনগুলোতে দুটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটেছে, বিষয়টি কী অবস্থায় ঘটেছে বা সেখানকার অবস্থাটা এখন কী সেটা লিখে সবসময় প্রকাশ করা যায় না।
“কাজেই আমার ধারণা মন্ত্রণালয় মিশন প্রধানদের কাছ থেকে শুনতে চায় আসল সমস্যাটা কীরকম ছিল, এখন কোথায় আছে, ভবিষ্যতের জন্য তাদের প্রেডিকশন কী, তারা কী ভাবছে,” বলেন মি. কবির।
এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের কী করা উচিত তাও আলোচনা হয়ে থাকে কনসালটেশনে।
“ওদেরকে ডেকে আনার মধ্যে বাড়তি কিছু চিন্তার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না,” বিবিসি বাংলাকে বলেন হুমায়ুন কবির।
পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে টানাপোড়েন ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক মোটামুটি সচল থাকলেও ভিসা বন্ধ। জনসাধারণ পর্যায়েও সম্পর্কের একটা বড় অবনতি হয়েছে।
একদিকে ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংখ্যালঘু এবং হিন্দুদের ওপর হামলা এবং অত্যাচারের নানা রকম তথ্য, অপতথ্য এবং গুজব ব্যাপকভাবে প্রচার হতে দেখা গেছে।
অন্যদিকে, অভ্যুত্থানকারী ছাত্রনেতা এবং বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায় ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তিগুলো থেকে ভারত যে যে বার্তা পেয়েছে সেটি নিয়ে তাদের অস্বস্তি আছে।
দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য বিবৃতিও চলে আসছে।
ঘটনা আরো ঘনীভূত হয় সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার ও তার জামিন নামঞ্জুরকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, এবং এসময় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যার ঘটনা ঘিরে।
মি. দাসের মুক্তির দাবিতে কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশন অভিমুখে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপিসহ কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করতে শুরু করে। ভারতের আরো কয়েকটি বাংলাদেশি মিশনের কাছেও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের খবর পাওয়া যায়।
ঘটনা পরম্পরায় ২৮শে নভেম্বর কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়।
বাংলাদেশেও ভারতের পতাকাকে অবমাননা করা হচ্ছে এমন অভিযোগে সরব হন ভারতের অনেকে।
এরপর দোসরা ডিসেম্বর হঠাৎই আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, ভাঙচুর ও পতাকা অবমাননার ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় বাংলাদেশ ‘ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া’ জানায়।
অন্যদিকে ভারত দুঃখ প্রকাশ করে। পরবর্তীতে এ ঘটনায় কয়েকজনকে আটক ও তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
দুই দেশেই কূটনৈতিক মিশনগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
বিবিসি বাংলা