এই দিনে এখানে নানা ধর্ম-বর্ণের লোক জগন্নাথদেবের মূর্তি এক নজর দেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে সমায়েত হয় রথ-চত্বরে। জগন্নাথদেবও তাঁর জগৎজনকল্যাণময় মূর্তি নিয়ে মন্দিরের পূজাবেদী হতে বেরিয়ে এসে রথারোহণে যাত্রা শুরু করে দেন । বৎসরে একবার দর্শন দিয়েও তিনি অসংখ্য ভক্তের চিত্তবিহারী হয়ে ভক্তহদয়ে অবস্থান করেন।
কোন কোন সূত্র থেকে জানা যায় যে, প্রায় ৪০০ বৎসর ধরে চলে আসছে ধামরাইয়ের রথযাত্রার অনুষ্ঠান। ধামরাইয়ের যশোমাধব মন্দিরের পরিচালনাপর্ষদের কাছ থেকে জানা যায় মতে প্রায় ২০০ বছর আগে ধামরাইয়ের যশোমাধব রথযাত্রা উৎসবের সূচনা হয়। কিংবদন্তী আছে, পালবংশের শেষ রাজা যশোবন্ত পাল একদিন গজে আরোহণ করে ধামরাইয়ের শিমুলিয়ায় বেড়াতে আসেন। পথে শিমুলিয়ার উপকণ্ঠে একটি লাল মাটির ঢিবির কাছে এসে রাজার হাতি থেমে যায়। পরে রাজার আদেশে ঐ মাটির ঢিবি খনন করে একটি মন্দিরের সন্ধান মেলে। ঐ মন্দিরটিতে মাধব বিগ্রহসহ আরও কিছু বিগ্রহ পাওয়া যায়। রাজা যশোবন্ত পাল সকল বিগ্রহ সংগ্রহ করে শিমুলিয়ার বিভিন্ন স্থানে পূজার জন্য স্থাপন করেন। রাজা মূল বিগ্রহটিকে ধামরাইয়ে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একজন ব্রাহ্মণকে দায়িত্ব দেন। এরই ধারাবাহিকতায় রাজার নাম সংযুক্ত করে মন্দিরের নাম হয় যশোমাধব মন্দির।
এখানেই মাধব বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় স্থানটির নাম হয়েছে মাধববাড়ি। প্রথমে একটি কুঁড়েঘরে মাধবের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল বলে জানা যায়; আর মাধবের রথখানিও ছিল তখন বংশদণ্ড নির্মিত। পরে কবে কোন সময় মাধরের কুঁড়ের ঘরের মন্দিরের স্থলে পাকা দালান ও বংশদণ্ড রথের বদলে কাঠের রথ তৈরী হয়েছিল তাঁর সঠিক তথ্য জানা যায় নি। জনশ্রুতি আছে যে, দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ২৫০ জন দক্ষ কাষ্ঠশিল্পীর অক্লান্ত পরিশ্রমে ধামরাইয়ের প্রথম কাঠের রথখানি তৈরী হয়েছিল।
এই কাঠের রথে নানা কারুকার্যখচিত মহাভারতের কাহিনী ও কলিকালচিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। ৩২ চাকার উপর প্রতিষ্ঠিত রথখানির উচ্চতা ছিল ৮০ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ছিল যথাক্রমে ৪০ ফুট ও ৪৫ ফুট। তিনতলা বিশিষ্ট রথখানিতে সুদৃশ নয়টি কক্ষ থাকায় এটিকে নবরত্ন রথ বলা হত। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় হানাদার বাহিনীর দোসরদের কালছোবলে ঐতিহ্যবাহী ধামরাইয়ের রথটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এর পর আগের রথের আদলে আর একটি রথ তৈরীর প্রয়াস থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় নি নানা কারণে।
পরে ৩০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট আর একটি রথ তৈরী হয় যা বর্তমানে ধামরাইয়ের রথ হিসেবে আজও বিদ্যমান। শ্রীশ্রীজগন্নাথ-দেবের জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছর আষাঢ় মাসে নানা উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে পালিত হয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে জগন্নাথদেব হলেন পাপবিমোচনকারী সাক্ষাৎ বিষ্ণুর অবতার। জনশ্রুতি আছে যে ধামরাইয়ের এতিহ্যবাহী সুপ্রাচীন রথের মেলা শুরু হয়েছিল ১০৭৯ বাংলা সনে।
প্রতি বছর আষাঢ় মাসে দশ দিনের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে আসে রথ যাত্রার মেলা। প্রতি বছর যশোমাধবের বিগ্রহ মাধবমন্দির থেকে রথে উঠিয়ে ধামরাই পৌর এলাকায় গোপনগরে নিয়ে যাওয়া হয়। রথের এ যাত্রাকে বাবার বাড়ী থেকে শ্বশুরবাড়ি যাত্রা বলে বিশ্বাস করা হয়। রথখোলায় গোপনগরে দশদিন অবস্থান করার পর দশম দিনে আবার উল্টোরথ যাত্রার মাধ্যমে যশোমাধবকে আবার মাধবমন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়। বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি জেলায় রথযাত্রার উৎসব পালিত হয়। ফরিদপুরের শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গন মহাউদ্ধারণ মঠের আয়োজনে প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের শ্রীমূর্তি রথে চড়িয়ে রথযাত্রা করা হয়।