রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৩ পূর্বাহ্ন

এয়ার বি এন বি

  • আপডেট সময় বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Young woman pulling a suitcase opening the front door of her rental accommodation during a vacation trip
অদৃষ্ট আসলেই অদ্ভুত, কখন কাকে কোথায় নিয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। জীবনের মোড় যেকোনো সময় ঘুরে যেতে পারে, ছোট্ট একটা আইডিয়া থেকে মানুষ পরিণত হতে পারে বিশ্বের এক আইডলে। বেকার যুবক হয়ে যেতে পারে বিলিয়ন ডলারের মালিক। ট্রাভেল বাংলাদেশের পাঠকদের আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক তেমন ৩ তরুণ উদ্যোক্তার গল্প বলব, যারা প্রায় বিনা পুঁজিতে আজ ৩৮ বিলিয়ন ডলারের এক প্রতিষ্ঠানের মালিক। আজ থেকে প্রায় ১৩ বছর আগের কথা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্যানফ্রান্সিসকো অঙ্গরাজ্যের দুই কলেজ গ্র্যাজুয়েট তাদের বাড়িভাড়া পরিশোধ করা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় আছে। সামনের মাসেই বাড়িভাড়া বেড়ে যাবে ২৫ শতাংশ। ঠিক এমন মুহূর্তে তাদের জন্যে সৌভাগ্য বয়ে আনে শহরটিতে তরুণ ডিজাইনারদের জন্যে আয়োজিত এক সম্মেলন। যে সম্মেলনকে ঘিরেই একটা আইডিয়া মাথায় আসে জো গেবিয়া’র, যে আইডিয়ার কথা বন্ধু  ব্রায়ান চেসকিকে একটি ই-মেইলে জানায় সে।
আর সে ই-মেইল এর আইডিয়া থেকেই আজকে প্রায় ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রতিষ্ঠান হয়েছে এয়ারবিএনবি। হ্যা, এক সময় যাদের বাড়ি ভাড়া পরিশোধের চিন্তায় ঘুম হারাম হবার উপক্রম হয়েছিল, আজ তাদের একটি আইডিয়া বিশ্বে বহু মানুষের আবাসন সংকটকে লাঘব করে দিয়েছে। এর ফলে এই দুই উদ্যোক্তা পরিণত হয়েছে সফলতার মাপকাঠিতে।

এয়ার বি এন বি

যেভাবে শুরু হলো এয়ার বি এন বি :

সময়টা ২০০৭ সালের অক্টোবর মাস, ডিজাইনারদের সম্মেলনকে ঘিরে যে আইডিয়া জো-এর মাথায় এসেছিল, সেটি ছিল এমন : তাদের লিভিং রুমে একটি এয়ার-বেড ম্যাট্রেস দিয়ে রাতের জন্য ভাড়া দিবে। যেহেতু তারা দুজন ও ডিজাইনিং-এর শিক্ষার্থী, তাই এই তরুণ ডিজাইনারদের কাছে ভাড়া দিলে দেখা হতে পারে কিছু নতুন আর পরিচিত মুখের সাথে। আর এর সাথে তারা কিছু পয়সাও আয় করার সুযোগ পাবে।

রোড আইল্যান্ড স্কুল অফ ডিজাইনিং কলেজে দেখা হওয়া এই দুজনই ভেবেছিলেন ডিজাইনারদের ট্যুর গাইড হিসাবে কাজ করে অর্থোপার্জন করাটা মজাদার উপায়। তবে, তাদের প্রথম আয়ের সূচনা করা ঐ ম্যাট্রেসটির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেই পরবর্তীতে তাদের কোম্পানির নাম রাখা হয় ‘এয়ারবিএনবি’।

বিএনবি বা বিঅ্যান্ডবি এর পূর্ণরূপ হলো ‘ব্রেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট’। তাদের আইডিয়ার মধ্যে রুম শেয়ার এবং নাস্তা দেয়ার পরিকল্পনা ছিল। আমাদের দেশের সংস্কৃতিতেও এটা নতুন কোনো ধারণা না। আমাদের বাসায় কেউ বেড়াতে এলে কিংবা কোনো অপরিচিতকে একরাতের জন্যে আশ্রয় দিলে আমরা তাদের সাথে নাস্তাও দেই। ঠিক এই বিষয়টাকেই তারা ব্যবসা হিসেবে কাজে লাগিয়েছে।

এয়ার বি এন বি

এমন অনেক বাড়ি আছে যেখানে অতিরিক্ত অনেক ঘর ফাঁকা থাকে, সেসব ঘর সাময়িক সময়ের জন্যে ভাড়া দিয়ে পয়সা করাও নতুন কোনো কিছু নয়। ঢাকা শহরের আনাচে কানাচে আমরা একে সাবলেট হিসেবে জানি। তারা শুধু এই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে একটা বিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠান। স্যানফ্রান্সিসকোর রাউশ স্ট্রিটে তাদের অ্যাপার্টমেন্টে তিন অতিথিকে বিছানা ভাড়া দেয়ার মাধ্যমে এয়ারবিএনবির বীজ রোপণ করা হয়েছিল, বাকিটা ইতিহাস বলা সহজ হলেও এয়ারবিএনবি’র জন্য ব্যাপারটা সহজ ছিল না।
বিভিন্ন পদক্ষেপে তাদের নিতে হয়েছে ঝুঁকি। পথটা মসৃণ ছিল না, বারেবারে তাদের টেনে ধরেছে হতাশা, তবুও থেমে না থেকে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তারা এগিয়ে গিয়েছে। ২০০৭ সালে Airbedandbreakfast.com নামে তারা যাত্রা শুরু করেছিল। লিংকডইন-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা রিড হফম্যানের পডকাস্টে কথোপকথনে চেসকি জানান, শুরুর দিকে তেমন কেউই সাইটটি ব্যবহার করছে না। ২০০৮ সালের শেষ দিকে অনেক কাজ শেষে সম্ভবত দৈনিক ৫০ জনের মতো সাইটে প্রবেশ করতো যার থেকে প্রায় ১০-২০টা বুকিং আসতো।

এয়ার বি এন বি

দুই প্রতিষ্ঠাতা এই ব্যবসায়ের জন্য ক্রেডিট কার্ডে বিশাল ঋণ করে ফেলেছিল। চেসকির প্রায় ২৫ হাজার ডলার এবং গেবিয়াও হাজার হাজার ডলার ঋণ করে ফেলেছিল। তাদের ‘বেড এবং ব্রেকফাস্ট’ মডেলের ‘বেড’ অংশটি বিক্রি করা হয়নি। সুতরাং, নগদ অর্থের জন্য মরিয়া ব্রায়ান এবং জো ব্রেকফাস্ট অংশকে তাদের ব্যবসায়ের পরিকল্পনা হিসেবে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

ব্রায়ান এবং জো শীঘ্রই বুঝতে পারল যে তাদের ধারণাটি কত বড় হতে পারে। তারা তাদের পুরাতন রুমমেট নাথন ব্ল্লেচার্জিকের সাথে একত্রিত হয়ে এটিকে একটি ব্যবসায় হিসাবে গড়ে তুলেছিল। তারা প্রকৃতপক্ষে রুমমেট ম্যাচিং সার্ভিসে চার মাস ধরে কাজ করেছিল যতক্ষণ না তারা বুঝতে পারে রুমমেটস ডট কম ইতোমধ্যেই বাস্তবায়িত এক জিনিস। তারপরে তারা এয়ারবেডএন্ডব্রেকফাস্ট ধারণায় ফিরে গেল। ঠিক এমন সময় তাদের জন্যে আশীর্বাদ হয়ে এলেন রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বারাক ওবামা এবং জন ম্যাককেইন।
মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে তারা প্রচারণার জন্যে ডেনভারে গেলেন। ব্রায়ান তখন এয়ারবিএনবি সম্পর্কে বার্তাটি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। তখনকার মার্কিন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বেশ শক্তিশালী অবস্থানে ছিলেন বারাক ওবামা। তাই তার ভাষণ শুনতে শহরটিতে উপস্থিত হতে আগ্রহী সম্ভাব্য অতিথি ও সমর্থকের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। অথচ বিভিন্ন হোটেল, মোটেল ও প্রচলিত পদ্ধতিতে থাকার মতো ছিল কেবলই ৩০ হাজার রুম। ঠিক তখন একটা সমাধান নিয়ে এগিয়ে এলো এয়ারবিএনবি। সাধ্যের মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যে বাসস্থান সেবা নিশ্চিত করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জনগোষ্ঠীর নজর কেড়ে নিল।

এয়ার বি এন বি

তাদের ওয়েবসাইট ফের চালু করার মাত্র চার সপ্তাহের মধ্যে ভাড়া দিতে আগ্রহী হোস্টের সংখ্যা ০ থেকে বেড়ে দাঁড়ালো ৮০০-তে! নির্বাচনী অনুষ্ঠান শেষে যদিও তাদের সাইটের ট্রাফিক কমে গেল। তবুও, হতাশ না হয়ে, নতুন উদ্যমে বিনিয়োগকারীদের সাথে দেখা করা শুরু করলেন জো ও ব্রায়ান। কিন্তু, দুর্ভাগ্যক্রমে কেউই তাদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে রাজি হলো না। বহু দেনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেরাই নিজেদের কোম্পানির জন্য ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থা করার চেষ্টায় নামলো ব্রায়ান ও জো। বরাবরের মতোই, বিপদে আবারও আলো ছড়ালো তাদের প্রতিভার সুপ্ত প্রদীপগুলো। নির্বাচনী আবহকে কাজে লাগিয়ে তারা তৈরি করলো দুই ধরনের ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল বক্স-যাদের একটি ছিল ওবামা, এবং অন্যটি ম্যাককেইনের সমর্থনে।

ফান্ডিং :

দুই প্রার্থীর তুমুল জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে, রিপ্যাকেজড জেনারিক সিরিয়াল বক্স বিক্রি করে প্রাথমিক ফান্ডিংও জমিয়ে ফেলেছিল তারা। ৪০ ডলারে একেকটি বক্স বিক্রি শেষে তাদের আয় হয়েছিল ৩০ হাজার মার্কিন ডলার! শোধ করার পাশাপাশি ‘ওয়াই কম্বিনেটর’ এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা পল গ্রাহামের চোখে পড়লো তাদের এই অভিনব ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল প্রজেক্ট। প্রতিষ্ঠানটি স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোকে আর্থিক ও বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দান করার জন্য বিখ্যাত।

এয়ার বি এন বি

২০০৯ সালের এপ্রিলে, সংস্থাটি সিকোইয়া ক্যাপিটাল থেকে ৬ লাখ মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে, যার মধ্যে ইউনাইভার্সিটি ভেঞ্চারের অংশীদার জাভেদ করিম, কিথ রাবোইস এবং কেভিন হার্টজ অংশ নিয়েছে। ২০১০ সালের নভেম্বরে, এটি গ্রেইলক পার্টনার্স এবং সিকোইয়া ক্যাপিটালের নেতৃত্বে একটি সিরিজ ফান্ডে ৭ দশমিক ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছিল। ২০১১ সালের জুলাইতে কোম্পানিটি অ্যান্ড্রেসন হরোভিটসের নেতৃত্বে ১১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সংগ্রহ করেছে।

অন্যান্য প্রাথমিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ডিজিটাল স্কাই টেকনোলজিস, জেনারেল ক্যাটালিস্ট পার্টনার্স এবং এ গ্রেড ইনভেস্টমেন্টের অংশীদার অ্যাশটন কুচার এবং গাই ওসারি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০১৪ সালের এপ্রিলে টিপিজি ক্যাপিটাল কর্তৃক ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং এর সাথে সংস্থাটির মূল্য দাঁড়ায় আনুমানিক ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। অ্যান্ড্রেসন হোরোভিটস, সিকোইয়া ক্যাপিটাল, ড্রাগনির ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপ, টি। রোয়ে প্রাইস এবং শেরপা ক্যাপিটাল অতিরিক্ত তহবিল সরবরাহ করেছিল।

২০১৫ সালের জুনে এয়ারবিএনবি জেনারেল আটলান্টিকের নেতৃত্বে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন তহবিল সংগ্রহ করেছে এবং হিলহাউস ক্যাপিটাল গ্রুপ, টাইগার ম্যানেজমেন্ট, ক্লেইনার পার্কিনস কফিল্ড অ্যান্ড বাইয়ার্স, জিজিভি ক্যাপিটাল, চায়না ব্রডব্যান্ড ক্যাপিটাল এবং হরিজনস ভেনচারের সাথে যোগ দিয়েছে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে, এয়ারবিএনবি গুগল ক্যাপিটাল অ্যান্ড টেকনোলজি ক্রসওভার ভেনচারের কাছ থেকে ৫৫৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সংগ্রহ করেছে।
আর এর সাথে সংস্থাটির মূল্য ৩০ বিলিয়ন ডলারে ঠেকে। ২০১৭ সালের মার্চে এয়ারবিএনবি ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করে, মোট তহবিল ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বেড়ে যায় এবং এই সংস্থাটির মূল্য নির্ধারণ হয় ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফোর্বসের মতে ২০১৯ সাল নাগাদ এভাবে সংস্থাটির আনুমানিক মূল্য এখন ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com