জামলিং তেনজিং নোরগে বলছিলেন, “আমি তাদেরকে সত্যিকারের অগ্রদূত এবং অভিযাত্রী হিসেবে দেখি, যারা অজানার পথকে জয় করেছে। তাদের দলবদ্ধ প্রয়াসের কারণেই আমরা আজ অনেক কিছু করতে পারছি।”
আজ থেকে ৭০ বছর আগে, ২৯শে মে’র সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটির কথা বলছিলেন জামলিং, যিনি পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট জয়ী প্রথম দুই অভিযাত্রীর একজন তেনজিং নোরগের সন্তান।
নিউজিল্যান্ডের মৌমাছি পালনকারী এডমন্ড হিলারি যখন নেপাল-চীন সীমান্তে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার যাত্রা শুরু করেন তখন তার সঙ্গে ছিলেন তেনজিং নোরগে।
ঐতিহাসিক দুই পর্বতারোহীর ছেলে, জামলিং তেনজিং নোরগে এবং পিটার হিলারি।
তারা নিজেদের বাবার কাছ থেকে সেই পর্বত জয়ের বীরত্বের গল্প শুনে বড় হয়েছেন।
পরবর্তীতে দুজনেই এভারেস্ট জয় করে তাদের বাবাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন।
এভারেস্ট জয়ের ঐতিহাসিক ৭০তম বার্ষিকীতে, বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে নিজেদের বাবার কৃতিত্বের কথা গর্বের সাথে তুলে ধরেন এভারেস্ট জয়ী বীরেদের সন্তানেরা।
১৯৫৩ সালের সেই পর্বতারোহণের ঘটনা এমন নজির স্থাপন করেছে যা কালে কালে অনুসরণ করা হয়ে আসছে।
চলতি বছর পর্বত আরোহণের মৌসুম শুরুর প্রথম দশ দিনের মধ্যে, ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ মাউন্ট এভারেস্টের ৮,৮৪৯ মিটার চূড়ায় পৌঁছেছে।
প্রযুক্তি, পর্বত আরোহণের সরঞ্জাম এবং যোগাযোগের উন্নয়নের কারণেই এমনটা সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু এডমন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগে জিপিএস বা স্যাটেলাইট ফোনের মতো আধুনিক গ্যাজেট ছাড়াই ওই কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন।
সেই সময় তাদের কৃতিত্বের খবর লন্ডনে পৌঁছতে তিন দিন সময় লেগেছিল।
“তারা যাত্রা শুরু করেছিলেন সাধারণ মানুষ হিসাবে এবং ফিরে এসেছেন বিশ্ব নায়ক হয়ে,” বলছিলেন জামলিং নোরগে, “কিন্তু এতো বড় অর্জন তাদের বদলাতে পারেনি।”
তারা দুজন আগের মতোই সাধাসিদা ছিলেন। দুজনই স্বভাবে ছিলেন নম্র।
দুজনই তাদের বাকি জীবন হিমালয়ের মানুষকে শুধু দিয়েই গিয়েছেন,” গর্বের সঙ্গে বলেন জামলিং।
এডমন্ড হিলারির ছেলে পিটার বলছিলেন, “যখনই কেউ এমন কোন কাজ করে যা আগে কখনও কেউ করেনি, তখন তারা অন্যদের অনুপ্রাণিত করে যে চাইলে আপনিও পারবেন। ৭০ তম বার্ষিকীতে আসুন আমরা সেই অর্জন উদযাপন করি।”
এই জুটি আগের তিন দশকে একাধিকবার এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। একের পর এক ব্যর্থতার পর এক পর্যায়ে তারা সফল হন।
তেনজিং দুই দশক ধরে ছয়বার এভারেস্টে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। যার মধ্যে একটি ছিল ১৯৫২ সালে, কিন্তু তিনি সেবার ব্যর্থ হন।
জামলিং বলেন, “আমার বাবা ছোটবেলায় ইয়াক চড়াতেন। তখন তাকে একটি বিষয় ভাবাতো, এভারেস্টের ওপর দিয়ে কেন কোন পাখি উড়তে পারে না।”
“তিনি লামার (একজন উচ্চ পদস্থ বৌদ্ধ পুরোহিত) ভবিষ্যদ্বাণী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, লামা তাকে বলেছিলেন যে এই পর্বত শিখরে একজন বৌদ্ধ অনুসারী প্রথম পা রাখবে।”
পিটার বলেছেন, যখন তার বাবাকে নবম ব্রিটিশ অভিযানে অংশ নিয়ে এভারেস্টের শিখর অতিক্রমের চেষ্টা করতে বলা হয়েছিল, তিনি তখনই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি ইতিহাস তৈরির একটি দুর্দান্ত সুযোগ পেয়েছেন।
পিটার বিবিসির উইটনেস হিস্ট্রি প্রোগ্রামে বলেছেন, “তিনি সবসময়ই জানতেন যে তিনি অসম্ভবকে জয় করতে চান। তিনি একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী লোক ছিলেন।”
“তার মুখে বলা ওই অভিযাত্রার একটি বিষয় আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে যে তিনি কিভাবে তুষার ও বরফের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ চূড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন,” বলছিলেন পিটার।
তিনি বলেছিলেন যে, তিনি সামনের দিকে ছিলেন, তুষার এবং বরফের পুরু স্তরগুলো কেটে কেটে হাঁটার ধাপ তৈরি করছিলেন। পরে সেই খাড়া ঢাল বেয়ে তিব্বতে নেমেছিলেন।
ভয়াবহ আবহাওয়া সত্ত্বেও তারা চলতে থাকেন।
পিটার মনে করেন যে এটি এভারেস্ট না হয়ে অন্য কোন পর্বত হলে তার বাবা হাল ছেড়ে দিতেন এবং অন্য কোন দিন ফিরে আসতেন।
তার বিশ্বাস যে তার বাবাকে ভেতর থেকেই কেউ বলছিল যেন তিনি চলতে থাকেন, হাল না ছাড়েন।
তারা যখন চূড়ায় পৌঁছান, তখন তাদের অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল খুব কম।
এজন্য বিশ্বের শীর্ষ চূড়ায় তারা মাত্র ১৫ মিনিট সময় কাটাতে পেরেছেন। এরপর তাদের নেমে আসতে হয়।
এভারেস্টের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পা রেখে তেনজিং দেবতাদের উদ্দেশ্যে বৌদ্ধ নৈবেদ্য হিসাবে কিছু মিষ্টি এবং বিস্কিট বরফের মধ্যে পুঁতে দেন।
এডমন্ড হিলারি চূড়ায় উঠে বেশ কয়েকটি ছবি তোলেন।
এরমধ্যে একটিতে দেখা যাচ্ছে, তেনজিং ব্রিটেন, নেপাল, জাতিসংঘ এবং ভারতের পতাকা ওড়াচ্ছেন।
সেইসাথে আশেপাশের দৃশ্যের ছবিও ধারণ করেন। কিন্তু চূড়ায় ওঠা অবস্থায় হিলারির কোনও ছবি ছিল না।
পিটার বলছিলেন, “বাবা মজা করে বলেছিলেন, যতদূর তিনি জানতেন, তেনজিং এর আগে ক্যামেরা ব্যবহার করেননি – এবং তিনিও মনে করেননি যে ওই ক্যামেরা দিয়ে তেনজিংকে প্রথম ছবি তুলতে বলা যেতো।”
কয়েক দশক পরে যখন পিটার এবং জামলিং এভারেস্টে আরোহণ করেন, তখন তারা দুজন আরও ভালভাবে বুঝতে পারেন যে তাদের বাবারা কোন অজানা পথগুলো অতিক্রম করেছিলেন।
“আমি প্রথম ১৯৯০ সালে আরোহণ করেছিলাম। আমি সে সময় আমার বাবার কথা ভাবা থামাতে পারিনি। যখন আমি হিলারির ধাপে পৌঁছলাম, তখন আমার বাবা যা দেখেছিলেন আমিও তাই দেখলাম। আমিও একই অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। পুরো বিষয়টা খুবই আবেগপ্রবণ ছিল,” পিটার বিবিসিকে বলেন।
জামলিং ১৯৯৬ সালে ধর্মীয় এবং ব্যক্তিগত কারণে ‘পর্বতারোহণ’ করেন।
তিনি এবং তার বাবা উভয়েই ছিলেন শেরপা। শেরপা হচ্ছে তিব্বতের একটি জাতিগোষ্ঠী যারা পর্বতারোহণের দক্ষতার জন্য বিখ্যাত।
শেরপারা হিমালয়ের সাথে নিজেদের গভীর আধ্যাত্মিক সংযোগ অনুভব করে।
“এটি আমার জন্য একটি তীর্থযাত্রার চেয়ে বেশি কিছু ছিল। আমি আমার ধর্ম এবং রীতিনীতির সাথে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করতে চাই এবং আমার বাবা কিসের মধ্য দিয়ে গেছেন তা বুঝতে চাই,” বলছিলেন জামলিং।
এখন প্রতি বছর বহু মানুষ এভারেস্ট জয় করছেন। পিটার বা জামলিং শিখরে পৌঁছালেও কেউই তাদের বাবারা যে ধরণের প্রশংসা পেয়েছিলের তারা কাছাকাছি কিছু অনুভব করতে পারেননি।
সম্প্রতি কামি রিতা ২৮তম বারের জন্য এভারেস্টের শীর্ষে আরোহণ করেছেন, আগেই এককভাবে সর্বোচ্চ বার এভারেস্ট জয়ের রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি। সেই রেকর্ড স্থাপনের মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় আবার নিজের রেকর্ডটি ভাঙেন তিনি।
তিনি বলেছেন যে, তিনি শীঘ্রই অবসর নেবেন না। কারণ পাসাং দাওয়া নামে এক শেরপার সাথে তার জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। এ কারণেই কামি রিতা এমন ঘোষণা দিতে পারেন।
পাসাং দাওয়া ইতোমধ্যে ২৬বার এভারেস্ট জয় করেছেন এবং আরও জয়ের প্রচেষ্টায় আছেন।
লাকপা নামে নারী শেরপা, নারী পর্বতারোহীদের মধ্যে রেকর্ড করেছেন, তিনি গত বছর ১০তম বারের মতো চূড়ায় উঠেছেন।
তবে এই শেরপাদের কেউ তাদের পরিবারের দেয়া নাম ব্যবহার করে না।
“আমার বাবার সময়ের তুলনায় এখনকার দিনে পর্বতারোহণ অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। এজন্য প্রযুক্তি অনেক সাহায্য করছে। এভারেস্টের চূড়া অতিক্রম করার পর কেউ কেউ এখন দুই নম্বর ক্যাম্প থেকে হেলিকপ্টারে করে কাঠমান্ডুতে যাচ্ছেন। সব রুট ঠিক করা আছে, অক্সিজেন এবং অন্যান্য সরঞ্জাম শেরপারা বহন করেন,” জামলিং বলেন।
“এখন আর আগের মতো অ্যাডভেঞ্চারের রোমাঞ্চ নেই। এটা একটা ফটোগ্রাফিক ইভেন্টে পরিণত হয়েছে। তারা শুধু আরোহণ করতে আসে না। তারা আসে উপভোগ করতে।”
পিটারও এই বক্তব্যের সাথে আংশিকভাবে একমত।
“আমাদের বেস ক্যাম্প থেকে চূড়া পর্যন্ত অসংখ্য দড়ি থাকে, খাদের উপরে মই বসানো থাকে, ক্যাম্পে গরম চাসহ শেরপা দল থাকেন। আপনাকে হেলিকপ্টারে ৬,৩০০ থেকে ৬,৫০০ মিটার পর্যন্ত নিরাপদে উদ্ধার করা যেতে পারে।”
“তবুও পর্বতটা একই। নানা চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির একটা বিশাল পর্বত।”
এখনও এই পর্বতারোহণকে খাটো করে দেখার উপায় নেই।
কারণ গত ১০০ বছরে ৩০০ জনেরও বেশি পর্বতারোহী মারা গিয়েছেন। শুধু এই মৌসুমে, মৃতের সংখ্যা ১১ জনে দাঁড়িয়েছে।
“পর্বত আপনাকে শেখাবে প্রকৃতিকে সম্মান করতে,” বলেছেন জামলিং, “আমরা এই পৃথিবীতে কয়েকদিনের অতিথি মাত্র।”