ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি করে মানুষ হত্যার দায়ে পুলিশের সাবেক আইজিপি থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যায়ের ১৮৪ কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম, ডিএমপি’র সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার, সাবেক ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধেই এখন পর্যন্ত ১২৬টি মামলা হয়েছে। তবে গত ৫ই আগস্ট গণআন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর থেকে এদের কারোরই আর বাংলাদেশের মাটিতে দেখা যায়নি। এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে আওয়ামী লীগ সরকারের ভ্যানগার্ডখ্যাত পুলিশের এই রাঘববোয়ালরা।
পুলিশ সূত্র বলছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৩৭টি, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমারের বিরুদ্ধে ২৯টি, সাবেক ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা প্রধান ও ডিএমপি’র সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুনের বিরুদ্ধে ৪৯ ও এসবি’র সাবেক প্রধান মনিরুলের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়াও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে হয়েছে ৪১টি, আরেক সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীরের বিরুদ্ধে ৩টি, ডিএমপি’র সাবেক কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের বিরুদ্ধে ১টি, সিআইডি’র মোহাম্মদ আলী মিয়ার বিরুদ্ধে ২টি, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে ৫টি, পুলিশ সদর দপ্তরের বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া অতিরিক্ত আইজি লুৎফুল কবীরের বিরুদ্ধে ১টি, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে ২টি, পুলিশ সদর দপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি জামিল আহমেদের বিরুদ্ধে ১টি, ডিএমপি’র সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার খন্দকার মহিদ উদ্দিনের বিরুদ্ধে ২টি, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেনের বিরুদ্ধে ১টি, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নূরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ২টি, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান (অতিরিক্ত কমিশনার) মো. আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৫টি, সাবেক ডিআইজি রিপন সরদারের বিরুদ্ধে ১টি, খালিদ হাসানের বিরুদ্ধে ১টি, অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ার্দারের বিরুদ্ধে ৫টি, ডিএমপি’র যুগ্ম কমিশনার মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে ৮টি, ডিবি’র এসআই অমিতাভ দর্জির বিরুদ্ধে ৪টি মামলা হয়েছে। এসব পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে সাবেক আইজিপি শহীদুল হক ও আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল কাফীসহ বেশ কয়েকজন আটক হওয়ার পর বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। তবে মামলা হওয়া কর্মকর্তার বেশির ভাগই রয়েছেন আত্মগোপনে। যাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। কেউ বিপুল টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে পার্শ্ববর্তী দেশের কাঁটাতার অতিক্রম করেছেন, কেউ আবার বিমানবন্দর দিয়ে দেশ ছেড়েছেন।
সম্প্রতি প্রচারিত হওয়া ডিবি হারুনের একটি সাক্ষাৎকারে ধারণা করা যায় বর্তমানে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তা। তিনি দাবি করেছেন- তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পরও তিনি চাকরিতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। তবে জীবনের মায়ায় তিনি চাকরিতে যোগ না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। তার স্ত্রী ও দুই সন্তান সেখানকার নাগরিক। সেখানে তার বাড়ি-গাড়ি সব রয়েছে। তাই আপাতত সেখানেই থাকবেন তিনি। এদিকে সাবেক এসবি প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামের ভারতের নয়াদিল্লিতে অবস্থানের প্রমাণ মিলেছে। সম্প্রতি তিনি নয়াদিল্লির কানঘট প্লেসের একটি গ্রোসারি স্টোর থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করছেন এমন ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তবে এক সাক্ষাৎকারে তার দাবি- তিনি দেশেই আছেন। জীবনের নিরাপত্তার জন্য বাড়িতে ফিরছেন না।
ডিএমপি’র আরেক দাপুটে সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারও গত ১০ই সেপ্টেম্বর লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছেন। তাকে সহায়তাকারী পাচারকারীদের এ সংক্রান্ত কয়েকটি কথোপকথনের অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ওই ঘটনায় সন্দেহভাজন পাটগ্রাম ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপক পঙ্কজ কুমার মদন নামে এক ব্যক্তিকে পাটগ্রাম শহর থেকে ১০ই সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে আটক করে স্থানীয় জনসাধারণ। পরে তাকে পাটগ্রাম থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।
এর আগে একইদিন বিকালে দহগ্রামের ডাঙ্গাপাড়া ওলেরপাড় এলাকার ওসমান গণির ছেলে পাচারকারী শুভ (৩০) রংপুরে টাকা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়ে। এই সময় স্থানীয় বিএনপি’র কয়েকজন নেতা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পাটগ্রামের বিএনপি’র কয়েকজন নেতার সঙ্গে শুভর ব্যাপারে কথা বলেন। ওই সময় শুভও সেই মোবাইলে কথা বলেন। কথা বলার একপর্যায়ে শুভ বলেন, ‘মঙ্গলবার রাতে পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকারকে দহগ্রাম সীমান্ত পথ দিয়ে ভারতে পার করে দেয়া হয়। এ সময় ব্র্যাক ব্যাংকের পঙ্কজ ও দহগ্রামের আকছেদুল, মমিন, লম্বা শাহীন, ফারুক, রাজীব, শামীম ও মকছেদুলের সহায়তায় বিপ্লবকে পার করা হয়। জলঢাকা মীরগঞ্জের মিঠু, নিশাদ, রুবেল বিপ্লবকে পাটগ্রামে আনতে সহায়তা করে। সীমান্ত পার করার সময় তার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেয়া হয়।’
এদিকে ডিএমপি’র সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানও ভারতে পালিয়েছেন বলে জানা গেছে। ভারতের টুরিজম স্পট গোয়া’র একটি হোটেলে তাকে এবং যুবলীগের সাবেক নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটকে দেখা গেছে। এ ছাড়াও গত ১৮ই সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর ব্যবহার করে সিডনি পালিয়ে গিয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মীর রেজাউর আলম। এর আগে গত ৪ঠা মে রাতে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। বিমানবন্দরের সিসিটিভির ফুটেজে তার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, পুলিশের যেসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই বিদেশে অবৈধভাবে অর্থপাচার করে বিপুল বিত্ত-বৈভব গড়ে তুলেছেন। এরমধ্যে সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিপুল পরিমাণ অর্থ সিঙ্গাপুরে সাবেক এক জাসদ ছাত্রলীগ নেতার হেফাজতে রয়েছে। হারুন অর রশিদ টাকার পাহাড় গড়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। হারুনের স্ত্রী ডিবি লটারির মাধ্যমে আমেরিকা যাওয়ার কারণে তিনি বেশির ভাগ অর্থ আমেরিকায় পাঠিয়েছেন। সাবেক ডিআইজি ইমাম হোসেনের থাইল্যান্ডে ব্যবসা রয়েছে। এ ছাড়া মনিরুজ্জামান ও বাতেনসহ অন্যরাও মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেছেন।
এসব বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য পুলিশ বদ্ধপরিকর। আপনারা ইতিমধ্যে দেখেছেন যে, যারা অপরাধী তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে এবং অপরাধী পুলিশ সদস্যদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া, যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়াও পুলিশের যে সকল সদস্য কর্মস্থলে অনুপস্থিত তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যক্রম ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।