শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ১২:০৭ অপরাহ্ন
Uncategorized

এক ‘স্বর্গরাজ্যের’ ইতিকথা

  • আপডেট সময় সোমবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১

দু’হাত দিয়ে হৃষ্টপুষ্ট চিকেন র্যা পটাকে আঁকড়ে ধরে বেশ একটা বড়সড় কামড় মেরে ভদ্রলোক ম্যাপের ওপর আঙুল রাখলেন। চওড়া গোঁফের খাঁজে মেয়োনিজের ক্রিমি অস্তিত্বটুকু টিসু দিয়ে মুছে ফেলে বললেন, “ইউটা হল গিয়ে পর্যটকদের প্যারাডাইস। শুষ্ক মরুভূমি থেকে শুরু করে গভীর জঙ্গল, বরফমুকুট শোভিত উত্তুঙ্গ পর্বতের সারি থেকে শুরু করে দমবন্ধ করা অতল গিরিখাত, কী নেই এখানে? ইউটার দক্ষিণের অপার্থিব শোভামণ্ডিত অঞ্চল বিশেষ করে কলোরাডো মালভূমি অঞ্চলটি গঠিত সুদৃশ্য স্যান্ডস্টোন দিয়ে। আপনারা যে রুট ধরে ‘জায়ান ক্যানিয়ন’ যাচ্ছেন, পথেই পড়বে ‘রেড ক্যানিয়ন’। প্রতিটি ক্যানিয়ন কিন্তু সৌন্দর্যে একে অপরের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা!” ইউটার রাজধানী সল্টলেক সিটি থেকে আমরা রওনা দিয়েছি জায়ানের উদ্দেশ্যে। ভদ্রলোকের উপদেশ কাজে লেগেছিল।

গাড়ি ছুটেছে জায়ান ন্যাশনাল পার্কের দিকে, আমেরিকার জনপ্রিয় ন্যাশনাল পার্কগুলির মধ্যে চতুর্থ এই পার্ক। পথেই পড়ে ডিক্সি ন্যাশনাল ফরেস্টের ‘রেড ক্যানিয়ন’। শুনেছিলাম, অসাধারণ প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার এই রেড ক্যানিয়ন পর্যটকদের কাছে কিছুটা অবহেলিতই রয়ে গিয়েছে। অথচ ইউএস রুট ৮৯-এর মাঝামাঝি স্টেট রুট ১২-তে অবস্থিত এই রেড ক্যানিয়ন আসলে পিনিয়ন, জুনিপার, পন্ডেরোজা পাইনের সবুজ সমুদ্র থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানো রক্তবর্ণ হুডুদের উন্নত শিখরে পরিপূর্ণ এক অদ্ভুত আশ্চর্য রূপকথার দেশ।

ক্যানিয়নের চারিদিকে লালপাথরের রক্তিম আভা, হলুদ সূর্যের আলো ঠিকরে যেন গনগনে আগুনের হলকা ছিটকে বেরোচ্ছে চারিদিক থেকে। যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেই লাল পাথরের চড়াইউৎরাই, পাহাড়, ক্ষয়প্রাপ্ত ছোটখাটো হুডূ। যদিও কাছেই অবস্থিত ইউটার ‘ফেয়ারিল্যান্ড’ সুবিখ্যাত ব্রাইস ক্যানিয়নের মত এই হুডুগুলো মোটেই অত বিশাল, পেঁচালো, ছুঁছলো নয়। ব্রাইস ক্যানিয়নে হুডূর সাইজ সাধারণ একজন মানুষের গড় উচ্চতা থেকে শুরু করে দশতলা বিল্ডিংয়ের সমানও হয়ে থাকে। সেখানে এই হুডুগুলো অনেকাংশেই ছোট। তবে ব্রাইস ক্যানিয়নের থেকেও অনেক বেশী রক্তাভ এই রেড ক্যানিয়ন, এবং এই সবুজের কন্ট্রাস্ট তাতে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। হুডু হল আসলে বিশেষ আকৃতির রক ফর্মেশন যা বরফ ও জলের ক্ষয়কার্যের ফলে গঠিত। এ যেন প্যারিডোলিয়া। যে দিকে তাকাই, পাথর খোদাই করাপ্রাকৃতিক মূর্তি সব।

হাতঘড়ির চঞ্চলতাকে বুকের ধুকপুকে কৌটোয় পুরে ফেলে আবার গাড়ি ছোটানো…ইউটা স্টেট রুট ৯-এর আঁকাবাঁকা, দিগন্তপ্রসারিত পথের এক অসাধারণ দৃশ্যপট ইতিমধ্যেই আমাদের বাকরুদ্ধ করে ফেলেছে। দুধারে রঙবাহারি, পাথুরে উঁচুনিচু টিলা, তরঙ্গায়িত রাস্তা যেন সর্পিল মাদকতায় বয়ে চলেছে একাকী! এমন মায়াবি রাস্তায় গন্তব্যটাই যেন গৌণ হয়ে যায়, সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে জেগে থাকে শুধু এক আবিল মুগ্ধতা। আমেরিকার রোড ট্রিপ সম্পর্কে একবার ‘দ্য টাইমস’ লিখেছিল, ‘a tradition that feels like a national birthright’!

আপাতত আমাদের গন্তব্য জায়ানমাউন্ট কারমেল টানেল। এই টানেলটি একটি ইঞ্জিনিয়ারিং বিস্ময়। তিন বছর নাকি লেগেছিল (১৯২৭-১৯৩০) এটি সম্পূর্ণ করতে। সেই সময় আমেরিকার এই ধরনের টানেলের মধ্যে এটিই ছিল দীর্ঘতম সেতু। এখানে পৌঁছে ট্রাফিকের জন্যে বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল আমাদের, বেশ সঙ্কীর্ণ টানেল। টানেলের মধ্যে গাড়ি থামানো নিষিদ্ধ।

আলোআঁধারি অপ্রশস্ত টানেল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল-যেন এক অন্য জগতে এসে পৌঁছেছি আমরা। জায়ান মাউন্ট কারমেল হাইওয়ের দুদিকে থোকা থোকা সেজব্রাশের ঝোপ, সুউচ্চ পাহাড়, পান্ডুর টিলা, আচমকা গভীর খাদ। পন্ডেরোজা পাইন, ফার আর অ্যাস্পেনের উঁকিঝুঁকি-আদিম সবুজ উদ্বেলতা। সভ্যতা থেকে অনেক অনেক দূরে যেন কোন এক প্রাগৈতিহাসিক উপত্যকা। একটু এগিয়েই ডানদিকে ভিজিটর সেন্টার। সাতদিনের পাস, মাথাপিছু ১২ ডলার, তবে প্রতি পরিবারপিছু তা কোনওভাবেই পঁচিশ ডলারের বেশি হওয়া চলবে না। জায়ান পার্কে পার্কিং লিমিটেড, অনেকেই কাছের স্প্রিংডেল টাউনে পার্ক করে ফ্রি টাউন শাটলে করে পার্কে আসে। ভিজিটর সেন্টারের কাছে গাড়ি পার্ক করে পার্ক ঘুরে নেওয়ার জন্য এই শাটলই আমাদের ভরসা, সেন্টারের কাছ থেকেই ফ্রি শাটল সার্ভিস রয়েছে। জায়ন ক্যানিয়নের সিনিক ড্রাইভে কিন্তু যখন শাটল চলে, তখন অন্য কোন প্রাইভেট গাড়ির সেখানে যাওয়ার অনুমতি নেই। নয়টি জায়গায় শাটল থামে। ভিজিটর সেন্টার, জায়ান হিউম্যান হিস্টরি মিউজিয়াম, ক্যানিয়ন জাঙকশন, কোর্ট অফ দ্য পেট্রিয়ার্কস, জায়ান লজ, গ্রটো, উইপিং রক, বিগ বেন্ড, টেম্পল অফ সিনাওয়াভা।

জায়ান ন্যাশনাল পার্ক ‘হোয়াইট ক্লিফ’ নামে বিখ্যাত, বছরের পর বছর ধরে নাভাহো স্যান্ডস্টোন ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট খাড়া উঁচু পাহাড়ের জন্যেই এই নামকরণ। ‘ক্লাইম্বারস প্যারাডাইস’ জায়ান ন্যাশনাল পার্কের দুহাজার ফুট উঁচু স্যান্ডস্টোন ক্লিফগুলির আকর্ষণ পর্বতারোহীদের কাছে চিরন্তন। ১৯০৯ সালে এটি ‘মিউকুন্টউইপ’ ন্যাশনাল মনুমেন্ট নামে অভিহিত হলেও ১৯১৮সালে সেই নাম পরিবর্তিত হয় ‘জায়ান ন্যাশনাল পার্কে’। খ্রিষ্টান মতবাদে, জায়ান হল স্বর্গরাজ্য। খেয়াল করে দেখলাম প্রত্যেকটি আউটক্রপিংয়ের নাম যেন বাইবেলের পাতা থেকে উঠে এসেছে… স্যান্ডস্টোন ক্লিফ ‘কোর্টঅফদ্যপেট্রিয়ার্ক’ মনে করিয়ে দেয় বাইবেলের আব্রাহাম, ঈশাক, জেকবের কথা। আছে ‘হগ অ্যালেনে’র কিংবদন্তি, যা একই সঙ্গে রসাল আবার ভীতিজনকও বটে। সেই গা ছমছমে কিংবদন্তির আবহ থেকে বেরিয়ে আসি আমরা জায়ানের সুবিশালতার মাঝে! ইউটার প্রাচীনতম পার্ক এই জায়ান আসলে ২২৯ বর্গমাইল বিস্তৃত এক প্রাকৃতিক বিস্ময়।

ক্যানিয়নের বুকে আলোছায়ার অতিন্দ্রীয় খেলার মাঝে তাকিয়ে দেখি, জুনের পলাতকা রঙিন বিকেল ক্লান্ত হয়ে নেমে এসেছে অদূরে ঋজু পন্ডেরোজা পাইনের ডালেবসে থাকা ‘গোল্ডেন ঈগলে’র চনমনে ডানায়। ছটফটে রেড ক্রসবিলের ঘর ফেরা উড়ান, পাখার ঝটপটানি চমকে দেয় গিরিখাতের নিশ্চল নীরবতা! এক আদিম প্রকৃতির বুনো সুর বুকের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠতে থাকে আমাদের বুকের গভীরে।

সন্ধের আঁধার জমাট বাঁধার আগেই এবার আমাদের ফেরার পথ ধরতে হবে।

কীভাবে যাবেন

দিল্লি, বেঙ্গালুরু, কলকাতা অথবা মুম্বই থেকে ফ্লাইট ধরতে পারেন। গন্তব্য সল্টলেক সিটি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। ইউটার রাজধানী এই সল্টলেক সিটি। পাসপোর্ট, ভিসার সমস্যা মিটিয়ে রাখতে হবে। একাধিক ট্রাভেলসাইট থেকে সাম্প্রতিক বিমানভাড়া এবং সময়সারণি পেয়ে যাবেন। দু-একটা দিন সল্টলেক সিটিতে থেকে সুন্দর শহরটা ঘুরে নেওয়া যেতে পারে।

কোথায় থাকবেন

ইউনিভার্সিটি গেস্ট হাউস, হ্যাম্পটন ইন, হিল্টন গার্ডেন ইন। সল্ট লেক সিটি থেকেই প্ল্যান করা যেতে পারে মাউন্ট রাশমোর, ডেভিলস টাওয়ার, ব্রাইস ক্যানিয়ন, ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক, লাস ভেগাস ট্রিপের। জায়ান ক্যানিয়ন যাওয়ার প্ল্যান করলে লগ ইন করতে পারেন জায়ান ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিসের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে। সেখানেই প্রয়োজনীয় তথ্য সব পেয়ে যাবেন।

কখন যাবেন

জায়ান ক্যানিয়ন সারা বছরই ঘোরা যায়, তবে এপ্রিল থেকে জুন আর অক্টোবর, নভেম্বর মনোরম সময়। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এখানে ‘ফ্লাশ ফ্লাড সিজন’,তাই এই সময়টা এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।

ট্রাভেল টিপস

জলের বোতল, টুপি, সানগ্লাস, সানস্ক্রিন লোশন, জবরদস্ত একজোড়া জুতো সমেত প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, পাসপোর্ট, ভিসা সঙ্গে রাখতে ভুলবেন না। পেটপুজো নিয়ে অহেতুক চিন্তা করার প্রয়োজন নেই, নানা মেক্সিকান রেস্তরাঁয় পছন্দমাফিক খাবার পেয়ে যাবেন। চাইনিজ, পিৎজা, বার্গারেরও অভাব নেই।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com