কল্পনা মনে হলেও, একদিনেই ঘুরে আসতে পারেন কলকাতা। তবে তার জন্য প্রয়োজন পার্ফেক্ট প্ল্যান। আর নষ্ট করা যাবে না এতটুকু সময়। তাহলেই কেবল আপনি একদিনে ঘুরে আসতে পারেন পাশের দেশের কাছের শহর থেকে।
কলকাতায় একদিনে কোথায় ঘোরা যায় একটা ফুল টিম নিয়ে, চিন্তা মাথায় ঘুরছিলো। যেহেতু সময় সীমিত এবং অনেকগুলো জায়গা ঘুরতে চাই, তাই গুগল ম্যাপের সহায়তা নিলাম। জায়গা তো অনেক আছে কিন্তু কোন জায়গাগুলো মাস্ট ভিজিট এবং একদিনে ঘুরে ফেলা যাবে তার একটা লিস্ট করার চেষ্টা করলাম ম্যাপে পিন দিয়ে। শুরুতে সেরা স্থানগুলো লিস্ট করলাম, তারপর ম্যাপে একটা সাথে আরেকটার ডিরেকশন দেখে ফুল ডে রুট বের করলাম। দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘোরা বা বিভিন্ন দেশে ঘোরার সময় এই পদ্ধতি ফলো করার চেষ্টা করি, অনেক কাজে দেয়।
সারাদিনের যেহেতু প্ল্যান তাই একটা ট্রাভেলার ভ্যান ভাড়া করে নিলাম। সকালে নাস্তা করেই হাতে পানির বোতল নিয়ে তাই যাত্রা শুরু হলো। দিনের প্রথম গন্তব্য ছিলো কলকাতা সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। তাজমহলের আদলে তৈরি বিধায় যখনই আসি তাজমহলের কথা মনে পড়ে। প্রচণ্ড রোদের মাঝে ঢুকে পড়লাম মূল ভবনে। কুইন ভিক্টোরিয়ার ১৮৭৬ থেকে ১৯০১ সালের শাসনামলের স্মৃতিকে স্মরণ করে রাখতেই তৈরি হয়েছিলো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। কুইন ভিক্টোরিয়ার মূর্তিসহ ব্রিটিশ সময়ের নানা হর্তাকর্তাদের মূর্তি আছে এখানে। দারুণ স্থাপত্যশৈলীর এই বিল্ডিংয়ে বর্তমানে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা স্মৃতি নিয়েও আলাদা কর্নার আছে; মাঝে মাঝেই নানারকম ঐতিহাসিক বিষয়ের উপর এক্সিবিশনও হয়। বিল্ডিংয়ের পেছনের পাশের সবুজ ঘাসের মধ্যে বসে দারুণ সময় কাটিয়েছি; ছবি নিয়েছি।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ঠিক পেছনের গেটের পাশেই অবস্থিত সেইন্ট পলস ক্যাথেড্রাল চার্চ। ১৮৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই চার্চটিই কলকাতার সবচেয়ে বড় চার্চ হিসেবে পরিচিত এবং এশিয়ার প্রথম অ্যাংলিকান ক্যাথেড্রাল। তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ শাসন এলাকার বাইরে তৈরি করা প্রথম নতুন চার্চ ছিলো এটি। দারুণ স্থাপত্যশৈলীর এই চার্চটি ঢুকলেই মনে হয় দারুণ কয়েকটি ছবি তুলি। চার্চে যখন পৌঁছলাম তখন প্রার্থনা চলছিলো; প্রার্থনার শেষ পর্যন্ত ছিলাম এবং ভিন্নরকম এক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরলাম।
পরবর্তী গন্তব্য প্রিন্সেপ ঘাট। কলকাতার আরেকটি মাস্ট ভিজিট স্থান জেমস প্রিন্সেপের স্মৃতিতে ১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত, হুগলী নদীর তীরে এবং বিদ্যাসাগর সেতুর পাশেই অবস্থিত প্রিন্সেপ ঘাট। প্রথমে স্মৃতিসৌধটি দেখে এরপর গেলাম হুগলী নদীর পাশে। নদীর সৌন্দর্য, বাঁধানো ঘাট ও বিদ্যাসাগর সেতুর সৌন্দর্য সব যেন একসাথে। সূর্য তখন মাথার উপরে, ফলে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গিয়েছে। ফলে, পরবর্তী গন্তব্য কলকাতার ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান, আরসালান রেস্টুরেন্ট এন্ড ক্যাটারার। প্ল্যান হচ্ছে আরসালানের মজাদার মাটন বিরিয়ানি খাওয়া। যেই প্ল্যান, সেই কাজ। সারাদিনের ট্রিপে ফুডলাভার হিসেবে এটি একটি মজার মেমোরি ছিলো।
আরসালানের সুস্বাদু বিরিয়ানি খেয়ে একবোতল থামস আপ নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। পরবর্তী গন্তব্য সায়েন্স সিটি। ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের সবচেয়ে বড় সায়েন্স সিটি এটি। এই সিটিতে সায়েন্স মিউজিয়াম, সায়েন্স পার্ক ও অডিটোরিয়াম আছে। বিজ্ঞানকে দারুণভাবে উপভোগ করার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে এই সিটিতে। ক্যাবল কার থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক গোলকধাঁধা কিংবা টাইম মেশিন থেকে শুরু করে স্পেস সেন্টার বা রকেট; সবই রয়েছে। বিজ্ঞানের নানা সূত্রগুলো কিভাবে কাজ করে এবং বিজ্ঞানের নানা মজার মজার এক্সপেরিমেন্টগুলোকে বাস্তবে দেখার সুযোগ রয়েছে এখানে। ফলে বাচ্চা থেকে শুরু করে সব বয়সীদেরই ভিড় লেগেই থাকে সায়েন্স সিটিতে। এখানে পুরোটা দিন কাটালেও কম মনে হয় কিন্তু আমাদের যেহেতু আরও কিছু গন্তব্য স্থান আছে তাই সিটির বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে দেখে, কেবল কারে চড়ে বের হলাম সিটি থেকে। পরবর্তী গন্তব্য জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি।
কলকাতার জোড়াসাঁকোতে অবস্থিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুর পরিবারের প্রাচীন বাড়ি এটি। বর্তমানে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ হিসেবেও ব্যবহার করা হয় এই বাড়িটিকে। ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকলেও ৪টা ৩০-এই টিকিট দেওয়া বন্ধ হয়। একটু দেরী হওয়াতে এবার ভেতরে না ঢুকলে পারলেও বাইরে থেকে বিল্ডিংটির স্থাপত্য উপভোগ করলাম। এর আগে অবশ্য বাড়ি ভেতরেও যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের নানা সময়ের অসংখ্য ছবি রয়েছে দেওয়াল জুড়ে। সারা বাড়ি-জুড়ে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত নানা আসবাব ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। রবীন্দ্রনাথের ভক্ত হলে এই বাড়িটি আপনাকে অনেক আবেগাক্রান্ত করে তুলবে। ঠাকুরবাড়ির সামনে থেকেই রসগোল্লা ও জিলাপি কিনে সবাই খেলাম। সে কি স্বাদ!
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামছে। ভিন্নরকম এক অভিজ্ঞতা নিতে আমরা গেলাম হুগলী নদীর পাড়ের শোভাবাজার ঘাটে। গাড়ি থেকে নেমে আমরা ৬ টাকার টিকিট করে ফেরিঘাটে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখান থেকে হাওড়া ব্রিজের ওপাশের ঘাট পর্যন্ত যাবো ফেরিতে। সন্ধ্যার সময় আলোয় আলোকিত হাওড়া ব্রিজের নিচ দিয়ে ফেরি দিয়ে পার হওয়ার অভিজ্ঞতা সত্যিই অতুলনীয়। আর সাথে হুগলী নদীতে নৌভ্রমণের অভিজ্ঞতাও নেওয়া হয়ে গেলো। হাওড়া ঘাটে নেমে বের হলেই সামনেই হাওড়া রেল স্টেশন। সময় থাকলে এর অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী উপভোগ করতে ভুলবেন না। হাওড়া স্টেশন থেকে যদি আপনার কোন ট্রেন থাকে তাহলে সেই টিকিট দেখিয়ে রেস্টরুমের এন্ট্রি নিতে পারেন; এই রেস্টরুমের সামনের অংশ থেকে হাওড়া ব্রিজকে দারুণভাবে উপভোগ করা যায়। ঘাট থেকে নেমে আমরা হাওড়া ব্রিজে উঠলাম। সেখানে কিছুক্ষণ নদী ও এর উপরের এই অত্যাশ্চর্য ব্রিজটিকে দেখলাম।
হাওড়া ব্রিজ থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কলেজ স্ট্রিটের ঐতিহ্যবাহী কফি হাউজে গিয়ে কফি খাওয়া ও সন্ধ্যার নাস্তা সেরে নেওয়া। কফি হাউজের বাইরের পানিপুরি দিয়ে শুরু করে কফি হাউজের স্পেশাল কফি, চিকেন-বিফ কাটলেট ও পাকোড়ার স্বাদ অতুলনীয়। সবসময় ভর্তি এই কফি হাউজের এতো মানুষের ভিড়েও যেন আলাদা ভালোলাগা কাজ করে। সবাই মিলে জমজমাট আড্ডা দিলাম, কফি-কাটলেট খেলাম, ছবি নিলাম; দারুণ সময় কাটলো। কফি হাউজের আড্ডা শেষ করার মাধ্যমে একদিনের ট্রিপও শেষ হলো। কফি হাউজ থেকে হোটেলে ফিরে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে অবশ্য আবার রাতের কলকাতাকে উপভোগ করতে বের হলাম। পার্ক স্ট্রিটে ‘সামোয়ার এলস’ মিউজিক ক্যাফেতে লাইভ মিউজিক উপভোগ করলাম।
একদিনে কলকাতাকে সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করা অসম্ভব। তবে একদিনের ট্রিপে এই প্ল্যানে ঘুরলে কলকাতার মূল দর্শনীয় স্থানের অনেকগুলোই দেখা হয়ে যায় এবং দারুণ কিছু অভিজ্ঞতাও নেওয়া হয়। তাই যদি কলকাতাতে একদিনের ট্রিপ প্ল্যান করে তাহলে এই ট্যুরকে ফলো করতে পারেন; আশা করি দারুণ একটি দিন কাটবে।