সাঁওতালদের উৎসব :
১। কারাম উৎসব :
সাঁওতাল, ওঁরাও, মালো, মুন্ডা, মাহাতো, ভুইমালি সম্প্রদায়ের আদিবাসীরা বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করে। ‘কারাম উৎসব’ নামক একটি বড় পূজা করে তারা। এটি তাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এই পূজার রীতিনীতি হচ্ছে কারাম গাছের ডালকে ঘিরে। কারাম নামক গাছের ডালকে ঘিরে এ পূজা হয় বলে এই উৎসবকে ‘ডাল পূজা’-ও বলা হয়।
২। ঋতু ভেদে উৎসব :
সাঁওতালরা বারো মাসে তেরো উৎসব পালন করে। এক কথায় এরা উৎসব মুখর জাতি। তাদের নতুন বছর শুরু হয় ফাল্গুন মাসে। নববর্ষে পালিত হয় বাহা উৎসব। নাচ গান করে আগমন করে নতুন বছরের। এছাড়াও এরা প্রতি ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন উৎসব পালন করে থাকে। যেমন- চৈত্র মাসে পালন করে বোঙ্গাবোঙ্গি, বৈশাখে হোম, জ্যৈষ্ঠমাসে এরো, আষাঢ় মাসে হাঁড়িয়াও, আশ্বিনে দিবি, পৌষ শেষে সোহরাই। বসন্তে তারা পালন করে ফুলফোটা উৎসব। বসন্ত উৎসবে তরুণ তরুণীরা তাদের সঙ্গী নির্বাচনের সুযোগ পায়। বিয়েতে কনেকে পণ দেয়ার প্রচলন রয়েছে। যদিও তা খুব সামান্য পরিমাণের হয়ে থাকে। বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত মেয়েদের পুরনায় বিয়ে করার প্রচলন রয়েছে সাঁওতাল সমাজে।
রাখাইন উৎসব :
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনরা জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদে বিশ্বাসী। রাখাইন আদিবাসীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমা। এছাড়াও আশ্বিনী পুর্ণিমা,কঠিন চীবর দান উৎসব এবং আষাঢ়ী পূর্ণিমার মত ধর্মীয় অনুষ্ঠান এরা পালন করে থাকে। রাখাইনদের বর্ষবরণের উৎসবকে বলা হয় সাংগ্রেই। টানা চার দিন ব্যাপী তাদের এই অনুষ্ঠান চলে। রাখানদের এই নবান্ন উৎসবে যাত্রা হয়, খেলা হয় জলকেলি। বছরের নতুন দিনের আনন্দে তৈরি হয় নানা রকমের পিঠাপুলি, বিন্নি ধানের ভাত এবং কাঁচা কচি ধানের চিড়া।
মণিপুরী উৎসব মহা রাসলীলা :
সমাজে কার্তিকীয় পূর্ণিমা তিথিতে উদযাপিত মহা রাসলীলা (রাসোৎসব) উৎসবটি সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ এবং আদমপুরে এ উৎসবটি পালিত হয়। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এই দেড়শ বছরেরও পুরোনো ঐতিহ্য দেখতে যায়। অনুষ্ঠানে দেখা মেলে মণিপুরীদের নৃত্য। বসে গ্রামীণ মেলা। দর্শনার্থীরা ভিড় জমায় মেলায়ও। মণ্ডপগুলো সাজানো হয় নানা নকশা ও কারুকাজ বহুল কাগজ ব্যবহার করে। এছাড়াও বিষু, সংক্রান্তি উৎসব, নোয়াভাত খানা/চানঙ তাংপা ইত্যাদি উৎসবও রয়েছে তাদের উৎসবের তালিকায়। মণিপুরীদের বিয়ে নিজেদের সমাজে হতে হয়, না হলে তাদের সমাজচ্যুত হতে হয়। বিবাহ দুটি পর্বে বিভক্ত : ১। বিবাহ অনুষ্ঠান ২। ঠিল্পা অনুষ্ঠান মণিপুরীদের নারী ও পুরুষ লিঙ্গভেদে যথাক্রমে সিনহা ও সিংহ উপাধি নেয়। তারা পূর্বে সমতল ভূমিতে চাষবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। মণিপুরীদের বাড়িতে মাঙ্গলিক স্থান হিসেবে তুলসজ শাং থাকে।
গারো উৎসব :
গারোদের বেশ কিছু উৎসবের মধ্যে আগাল মাক্কা বা আচিরক্কা, রংচু গাল্লা, জামে গাপ্পা-আহাওয়া, ওয়ানগালা অন্যতম। গারো সমাজে সন্তান জন্মদান পুরো গ্রামের জন্যে উৎসবের আমেজ থাকে। সবাই ওইদিন ‘চু-জাঙ্গি’ মদ পান করে। তাদের পালিত ওয়ানগালা উৎসবটি বেশ আকর্ষণীয়।
ওয়ানগালা উৎসব :
নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় মান্দিরা ওয়ানগালা উৎসবের আয়োজন করে। বর্ষার শেষের দিকে এবং শীতের আগ মুহূর্তে এ উৎসবটি পালিত হয়।‘ওয়ানগালা, ওয়ানগালা আচিকরাং ওয়ানগালা, ওয়ানগালা, ওয়ানাগালা… মিদ্দিনা রুগালা’ গানের সুরে মেতে তাদের উঠে গ্রামগুলো। এই উৎসবের পেছনের কারণ হচ্ছে সূর্য দেবতা মিসি সালজংয়ের প্রতি তাদের বিশ্বাস। তাদের বিশ্বাস সূর্য দেবতার নির্দেশেই বীজ থেকে চারা এবং চারা থেকে ফসল হয়।
তাই দেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য এ উৎসবটি পালন করে তারা। দেবতাকে ধন্যবাদ না দেয়ার আগ পর্যন্ত নতুন ফসল ঘরে তোলা যায় না। তাই এই উৎসবকে ধন্যবাদের উৎসবও বলা হয়। এ উৎসব পালন করা হয় তিন দিন ব্যাপি। প্রথম দিনকে বলা হয় ‘রুগালা’, দ্বিতীয় দিনকে ‘সাসাত স’আ’ ও তৃতীয় দিনকে বলা হয় ‘ক্রাম গগাতা’। দিনগুলো খুব আনন্দ উৎসবেই কাটে তাদের। ধান কেটে দেবতাকে উৎসর্গ করে আঁটি বেঁধে আনন্দে গান গেতে গেতে বাড়িতে প্রথম ধান তোলে। ফসলের সাথে দেবতাও তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে বলে তারা বিশ্বাস করে। সূর্যদেবতার নামে মোরগ উৎসর্গ করা হয় প্রথম দিন। নতুন চাল দিয়ে তৈরি করা হয় চু বা মদ। মদসহ দেবতাকে উৎসর্গ করা হয় বিভিন্ন ফল, শাকসবজি, নতুন ধানের ভাত এবং পশুপাখি। ওয়ানগালা উৎসবে ঘরের সবাই নতুন পোশাক পরে। ঘরকে করা হয় পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে পালন করা হয় দিনগুলো।