ইউরোপ হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যের এক সমৃদ্ধ মহাদেশ, শুধু যে ইউরোপ ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়েছে তা নয় সাথে সাথে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করতে পেরেছে বলতে গেলে বিভিন্ন যুদ্ধ-বিগ্রহ বিপ্লবের মাধ্যমে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করেছে। সবচেয়ে বড় ধাক্কা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এরপরে ইউরোপে আর তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা সইতে হয়নি। অর্থনীতির চাকা গতিশীলতা বিবেচনা করলে কৃষি বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তির অধিকাংশই ইউরোপ দ্বারা সৃষ্টি। সে কারণেই উন্নত বিশ্বের আরেক নাম ইউরোপ।
সংগত কারণেই বিভিন্ন দেশ থেকে উন্নত জীবনের জন্য সবাই ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে চায়, সঠিক পন্থা না জানার কারণে মানুষ বিপরীতমুখী হয়ে স্বপ্নযাত্রায় বেরিয়ে পড়ে অনেকেই প্রতারিত এবং বিপদের সম্মুখীন হন। তবে একটি পরিকল্পনা করলে খুব সহজেই যে যার অবস্থান থেকে ইউরোপে যেতে পারেন এবং প্রতিটি দেশের নিয়ম অনুযায়ী স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারেন।
চলুন জেনে নেই কি কি উপায়ে আপনি ইউরোপের যেতে পারেন এবং বসবাসের সুযোগ পাবেন: প্রধানত পাঁচটি উপায় আপনি ইউরোপে বসবাসের সুযোগ পেতে পারেন প্রথমত হাইলি কোয়ালিফাইড ওয়ার্কার বা উচ্চ যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মী অর্থাৎ প্রফেশনাল, আন্ত কোম্পানি স্থানান্তর কর্মী, গবেষক, ছাত্র, ভলেন্টিয়ার বা অবৈতনিক কর্মী। এছাড়া আপনি টুরিস্ট ভিসায় ভ্রমণ করতে আসলো যদি পর্তুগাল, স্পেন এবং ইতালি এই দেশগুলোতে চাকরি খুঁজে পান সে ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করা সম্ভব।
আজকে আমরা আলোচনা করব শুধুমাত্র হাইলি কোয়ালিফাইড ওয়ার্কার বা উচ্চ যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মী এই প্রোগ্রাম কে ইউ ব্লু-কার্ডঃ হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়।
ইইউ ব্লু-কার্ড কি?উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীদের জন্য এটি একটি স্কিম যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের দেশের উক্ত উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীদের ইইউ বসবাস এবং কাজ করার অধিকার দেয়। এই প্রোগ্রামের আওতায় আপনাকে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী এবং কাজের দক্ষতা থাকতে হবে। ডেনমার্কে এবং আয়ারল্যান্ড ব্যতীত ইইউ এর বাকি ২৫ টি দেশে এই প্রোগ্রামের আওতায় বসবাস এবং চাকরি করতে পারবেন। তাছাড়া জব কনট্যাক্ট এবং যে দেশে আবেদন করবেন তাদের গড় বেতনের দেড় গুণ বা এ প্রোগ্রাম দ্বারা নির্দিষ্ট বেতনের সমপরিমাণ বেতন পাওয়ার অধিকারী হতে হবে।
ইইউ ব্লু কার্ডের জন্য প্রতিটি দেশেরই আলাদা আলাদা নিয়ম রয়েছে চলুন জেনে নেই পর্তুগালের প্রেক্ষাপটের ব্লু-কার্ডঃ এর জন্য আপনার কি কি যোগ্যতা প্রয়োজন এবং কিভাবে আপনি আবেদন করতে পারবেন ।
আপনার কি কি যোগ্যতা প্রয়োজন:আবেদনকারীকে পর্তুগালের যে কোন কোম্পানিতে কমপক্ষে এক বছরের চাকরির চুক্তিপত্র (কন্ট্রাক বা এপয়নমেন্ট লেটার লাগবে (উভয় ক্ষেত্রেই পেশাগত প্রমাণের জন্য স্থানীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সত্যায়ন সহ) ।
উক্ত চাকুরীর বেতন পর্তুগালের গড় বেতন কাঠামো ১ দশমিক ৫ গুণ হিসেবে ২৪ হাজার ৫৩৫ ইউরো বাসরিক বেতন পাওয়ার অধিকারী হতে হবে।
আবেদনকারীর পেশা পর্তুগালের আইন অনুযায়ী স্বীকৃত হতে হবে রেগুলেটেড চাকরির ক্ষেত্রে এবং সে অনুযায়ী প্রমানপত্র উপস্থাপন করতে হবে । নন রেগুলেটর চাকরির ক্ষেত্রে উচ্চ পেশাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট উপস্থাপন করতে হবে।
মেডিকেল ইন্সুরেন্স এবং ভ্যালিড ট্রাভেল ডকুমেন্ট অর্থাৎ পাসপোর্ট, রেসিডেন্ট কার্ড (যারা ইতিমধ্যে ইউরোপের অন্যান্য দেশে আছেন তাদের ক্ষেত্রে)
এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায় আপনি কিভাবে চাকরি জোগাড় করবেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি চাকরির সাইট রয়েছে ইউরেস (EURES) এখানে বিভিন্ন পেশাগত হাজার হাজার চাকরির সুযোগ রয়েছে এবং আপনি দেশ মোতাবেক চাকুরী সংস্থান করে নিতে পারবেন।
লিংক https://ec.europa.eu/eures তাছাড়া আপনিি বিভিন্ন কোম্পানির সাথেে যোগাযোগ করে চাকুরীর সংস্থান করতে পারেন। আমাদের দেশ থেকে না হলেও প্রতিবেশী দেশগুলো থেকেেে বিপুল পরিমাণ উচ্চ দক্ষতাা সম্পন্ন কর্মী ইউরোপে কাজ করছেন।
কোথায় আবেদন করবেন:ইইউ ব্লু-কার্ড প্রোগ্রামের আওতায় আপনাকে পর্তুগালের যেতে হলে প্রথমে একটি স্বল্পমেয়াদী ওয়ার্ক পারমিট ভিসার আবেদন করতে হবে। পর্তুগালের ক্ষেত্রে সাধারণত ডি-৩ ভিসা।
ভিসা আবেদনের জন্য, আপনাকে পর্তুগালে বা ইউ এর যে দেশে আপনি চাকরি পেয়েছেন তার চুক্তি পত্রের কপি অথবা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার , ট্রাভেল ইন্সুরেন্স, পেশাগত সার্টিফিকেট, রিটার্ন টিকেট এবং পাসপোর্ট সহকারে সংশ্লিষ্ট এম্বাসিতে জমা দিতে হবে অনেকক্ষেত্রে এম্বাসি কার্যক্রম ভিএসএফ এর মাধ্যমে পরিচালিত হয় সে ক্ষেত্রে আপনি ভিএসএফ অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে জমা দিতে পারেন।
পর্তুগালে প্রবেশ করার পর আপনাকে পর্তুগাল ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ (SEF) অ্যাপয়নমেন্ট নিতে হবে আর্টিকেল ১২১-(এ) টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিটের জন্য। এবং অ্যাপয়নমেন্ট তারিখে আপনাকে কাজের চুক্তিপত্র(উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী হিসেবে), বসবাসের ঠিকানা, সোশ্যাল সিকিউরিটি নাম্বার, নিজ দেশের এবং পর্তুগালের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট এবং ইতিপূর্বে অন্য কোন দেশে থাকলে সংশ্লিষ্ট দেশের পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট। ইত্যাদি উপস্থাপন করতে হয়। সবকিছু ঠিক থাকলে বর্তমানে অস্থায়ী রেসিডেন্ট পার্মিট প্রথমে দুই বছর এজন্য পাবেনএবং পরবর্তীতে নবায়ন করলে তিন বছরের মেয়াদ প্রদান করা হবে।
ইইউ ব্লু-কার্ড এর ভিসা আবেদনের ক্ষেত্রে চাকুরী এবং বেতনের হিসাব অনুযায়ী যদি ঠিক থাকে তাহলে একশভাগ ভিসা পাওয়া যায় এবং পরবর্তীতে পর্তুগালের রেসিডেন্ট পেতেও কোন সমস্যা হয় না। তবে ইতিপূর্বে যদি ইউরোপের যে কোন দেশে ভিসা আবেদন করে রিফিউজ হয়ে থাকেন অথবা ইতিপূর্বে আপনাকে ইউরোপের কোন দেশ থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে অথবা আপনি কোন অপরাধ কর্মকাণ্ড করেছেন। সে ক্ষেত্রে একটি গ্রহণযোগ্য হবে না অর্থাৎ আপনার ভিসা আবেদন গ্রহণ করবে না
তাছাড়া পর্তুগালে আসার পর যদি কোন কারণে পর্তুগাল ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ আপনাকে আবেদন রিফিউজ করে সেক্ষেত্রে আপনার আপিল করার অধিকার থাকবে।
পর্তুগালের রেসিডেন্ট কার্ড পাবার পর কোন কারণে যদি আপনার চাকুরী চলে যায় এবং যদি রেসিডেন্ট কার্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় তাহলে নতুন চাকরি পাওয়ার আগে আপনি তা নবায়ন করতে পারবেন।
ইচ্ছা করলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে যদি যে কোন প্রকার ব্যবসা করতে চান সে ক্ষেত্রে খুব সহজেই ব্যাবসায়িক অ্যাক্টিভিটি খুলে আপনি ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন।
পর্তুগালে ৫ বছর অস্থায়ী রেসিডেন্ট হিসেবে বসবাস করার পর পর্তুগিজ ভাষা সম্পর্কে দক্ষতা সহ পর্তুগিজ ভাষা শিক্ষা সনদ থাকলে পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি কার্ড বা লং টাইম রেসিডেন্ট কার্ড এর জন্য আবেদন করা যায় । একই সাথে পর্তুগিজ নাগরিকত্ব আবেদন করা যায় এবং আবেদনের তিন মাস থেকে ১৮ মাসের মধ্যে নাগরিকত্ব লাভ করা যায়।
ইইউ ব্লু কার্ডের ক্ষেত্রে ইউরোপের সকল দেশের ক্ষেত্রে সাধারণত একই নিয়ম তবে পার্থক্যটা হয় উক্ত দেশের গড় বেতনে পরিমাণের উপর এবং নির্দিষ্ট চাকরি নিয়ে আপনি যাচ্ছেন সেই চাকরি ক্ষেত্রে যদি তাদের লোক কম থাকে । এর বাইরে ভিসা নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশভেদে সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আপনি যেই পেশাগত কাজে বা যে ধরনের পেশায় যাচ্ছেন অবশ্যই উক্ত পেশায় যে দেশে যাচ্ছেন সে দেশের স্থানীয় পেশাজীবী অপ্রতুল হলে বা চাহিদা পূরণে অক্ষম হলে সে ক্ষেত্রে তা গ্রহণযোগ্য হবে।
ইইউ ব্লু-কার্ডঃ এর সাথে সাধারণ ওয়ার্ক পারমিটের অনেক পার্থক্য রয়েছে কেননা ব্লু-কার্ড এর মাধ্যমে আপনি ইউরোপের যে দেশেই থাকুন না কেন পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে গেলে অথবা নাগরিকত্ব আবেদনের ক্ষেত্রে আপনি ইউরোপের অন্য দেশে থাকাকালীন সময়ে হিসাব করা হয় যদি একটু বুঝিয়ে বলি ধরুন আপনি ইতিপূর্বে জার্মানিতে তিন বছর কাজ করেছেন ব্লু কার্ডের মাধ্যমে এখন যদি আপনি পর্তুগালে একই ভাবে চাকরি জোগাড় করে থাকতে পারেন সেক্ষেত্রে আপনার দুই বছর থাকলেই আপনি স্থায়ী(পার্মানেন্ট) রেসিডেন্ট বা দীর্ঘমেয়াদী রেসিডেন্ট আবেদন করতে পারবেন। নাগরিকত্বের ক্ষেত্রেও কিছুটা ব্যতিক্রম রয়েছে তবে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে যে নাগরিকত্ব আইন প্রতিবেশী খুবই দ্রুত পরিবর্তন এবং সংশোধন করছে।সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ে উক্ত দেশের অর্পিত আইন কার্যকর হবে।
(লেখক : ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী, পর্তুগাল ।