করোনার আগে ঈদের ছুটির প্রতি দিনে অন্তত ২৫ হাজার দর্শনার্থী তাঁদের পার্কে আসত বলে জানান ড্রিম হলিডে পার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রবীর কুমার সাহা। নরসিংদী সদর উপজেলার চৈতাব এলাকার এই পার্ক মুখর থাকত। এবার সব শূন্য। প্রবীর সাহা বলেন, ‘৩০০ কর্মীর পেছনে মাসে ব্যয় ১৭ লাখ টাকা। পার্কের সামনে আনসারের একটি ক্যাম্প আছে। এর জন্য প্রতি মাসে পাঁচ লাখ টাকা আমাদের দিতে হয়। রাইডগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ তো আছেই। কিন্তু দুই ঈদই ছিল আমাদের আয়ের বড় উৎস। সেটা এবারও বন্ধ।’
এই ‘সুপার পিক টাইম’–এ করোনার আগে হোটেল রেইন ভিউয়ে প্রতিদিন ৩৫ কক্ষের একটিও খালি থাকত না। এ তথ্য জানালেন দুই তারকার এ হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুকিম খান। তাঁর কথা, ‘প্রতিদিন আয় হতো ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। ঈদের আগে পরে ১০ থেকে ১২ দিন জায়গা দিতে পারতাম না। কিন্তু সেই ব্যবসায় আর নেই।’
মুকিম খান কলাতলী মেরিন ড্রাইভ হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তিনি জানান, কক্সবাজার শহরে আছে সাড়ে ৪০০ হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট। এখানে কর্মচারীর সংখ্যা ৫০ হাজারের ওপরে। পর্যটনের সঙ্গে জড়িত তিন লাখের বেশি মানুষ।
গত বছর ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটির আদলে বিধিনিষেধ শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় হোটেলগুলো। খোলে গত বছরের ১৭ আগস্ট। এরপর চলতি বছরের ৫ এপ্রিল আবার বন্ধ হয়ে যায়। হোটেলগুলো যখন খোলা ছিল, তখন একটি ঈদও তাঁরা পাননি। তাঁদের সুপার পিক টাইমের ব্যবসায়ও হয়নি।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট-গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম শিকদার জানান, ঈদের সময় প্রতিদিন প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার পর্যটক প্রতিদিন এ শহরের থাকে। ব্যবসায় হয় প্রায় ১০০ কোটি টাকার। এবার এক পয়সাও আয় হলো না। বিধিনিষেধের কারণে হোটেল ব্যবসার ক্ষতি প্রায় এক হাজার কোটি টাকা।
একটি পর্যটন এলাকা মানে শুধু হোটেল বা রেস্তোরাঁ তো নয়। কক্সবাজারের কথাই ধরা যাক। সেখানে আছে ঝিনুকের ব্যবসা, সৈকতের দোকান, রিকশা, ছোটখাটো দোকানি—কত মানুষ এর সঙ্গে জড়িত। হিসাবে তাই এসবকেও নিয়ে আসতে হয়।
১৫ জুলাই পর্যটন খাতের হোটেল-মোটেল ও থিম পার্কের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য ঋণের সুদহার কমিয়ে ৮ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ৪ শতাংশ দেবে সরকার এবং বাকি ৪ শতাংশ গ্রাহকদের দিতে হবে।
পর্যটনের সঙ্গে অন্তত ৪৬ ধরনের ব্যবসায় যুক্ত থাকে বলে জানান ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) সরদার নূরুল আমিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পর্যটন এক বিপুল ক্ষতি গুনছে। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ট্রাইয়াব) সভাপতি কবির উদ্দিন আহমেদের হিসাব, এ খাতে ক্ষতি ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার মধ্যে।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোট ২১টি মোটেল আছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এর প্রতিটিই এখন ক্ষতি গুনছে প্রতিদিন। ২০২১-অর্থবছরে ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে বলে জানান পর্যটন করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মো. শহীদুল ইসলাম ভুঞা। প্রথম আলোকে বলেন, দুই ঈদের পর্যটন করপোরেশনের ক্ষতি প্রায় তিন কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে ঈদের সময় পর্যটন খাতের আনুমানিক ক্ষতি ২৫০ কোটি টাকার মতো হবে।
পার্বত্য জেলা রাঙামাটি শহরে হোটেল আছে ৬০টি। এ শহরের বড় আকর্ষণ থাকে কাপ্তাই লেক। সেখানে চলে নানা ধরনের ২০০টির বেশি নৌকা। সেটিও একটি বড় ব্যবসায়। ঈদের সময় প্রতিদিন হাজার দশেক মানুষ এ শহরে আসেন বলে জানান হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ। তাঁর হিসাব, ঈদে অন্তত ৫ কোটি টাকার ব্যবসা হয়; যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শহরটি।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সঙ্গে জড়িয়ে প্রায় ১০০ প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. মাসুদ হোসেন জানান, করোনার আগে ঈদের সময় একটি প্রতিষ্ঠানের ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার লেনদেন হতো। সেই হিসাবে ২০ কোটি টাকার মতো লোকসান হয়েছে ঈদের এ সময়ে।
বেঙ্গল ট্যুরের প্রধান মাসুদ হোসেন অবশ্য বলেন, সেই হোলি আর্টিজান হোটেলের হামলার পর থেকেই বিদেশি পর্যটক আসা কমে গেছে। এরপর করোনা এসে ক্ষতির চূড়ান্ত হয়েছে।
এই প্যাকেজকে স্বাগত জানালেও ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়ার জটিলতা একটি বড় বাধা বলে মনে করেন ট্রাইয়াবের সভাপতি কবির উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের প্যাকেজ আগেও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঋণপ্রাপ্তির জটিলতায় তার সুফল মেলেনি। ব্যাংকগুলো হোটেল-রিসোর্টকে লাভজনক বলে মনে করে না। তাদের মনে রাখা উচিত, আমরা কেউ রাস্তার লোক না। ঋণ দিলে আমরা ফেরত দেবই।’