ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে এবং হতাহতের তালিকাও ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে।
এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের দেশ দু’টো থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। সংকট সমাধানে আলোচনার কথা বলছে বিভিন্ন শক্তিশালী দেশ।
সারা বিশ্বের মানুষ এখন অনলাইন-অফলাইনে জানতে চাচ্ছে, ‘ইরান-ইসরায়েলের সর্বশেষ খবর’ আসলে কী?
এর মাঝে অনেকে ইসরায়েল সম্বন্ধে নির্দিষ্ট কিছু তথ্য জানতে চাচ্ছে। যেমন, ইসরায়েলের জনসংখ্যা, আয়তন কিংবা সেখানকার শহরগুলো সম্পর্কে।
ছবির উৎস,Getty Images
ইসরায়েল আসলে কোন মহাদেশে অবস্থিত? এর উত্তর, এশিয়া মহাদেশেই। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে মধ্যপ্রাচ্যে। এর পশ্চিম দিকে ভূমধ্যসাগর এবং পাশে রয়েছে লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, মিশর এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড।
ইসরায়েলের উত্তরে লেবানন, উত্তর-পূর্বে সিরিয়া, পূর্বে জর্ডান ও দক্ষিণ-পশ্চিমে মিশর।
ইসরায়েলের সঙ্গে গাজা উপত্যকার পূর্ব ও উত্তর দিকের সংযোগ থাকলেও সেখানে কঠোর চেকপোস্ট রয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ দিকে মিশরের সাথে গাজার সীমান্ত রয়েছে, যেখানে রাফাহ ক্রসিং অবস্থিত। এটিই গাজা ভূখণ্ডের জন্য একমাত্র সীমান্ত পথ।
তবে উল্লেখ্য, ইসরায়েলের পূর্বদিকে আবার ডেড সি বা মৃত সাগর রয়েছে। মৃত সাগরের অবস্থান ইসরায়েল, পশ্চিম তীর ও জর্ডানের সীমান্তবর্তী এলাকায়।
এদিকে, ইসরায়েলে সমুদ্র যেমন আছে, তেমন-ই এখানে পাহাড়, উর্বর ভূমি, মরুভূমিও রয়েছে। এগুলোর প্রত্যেকটিই একে অপরের বেশ কাছাকাছি অবস্থিত।
উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমে থাকা ভূমধ্যসাগর থেকে পূর্বের ডেড সি পর্যন্ত যেতে গাড়িতে মাত্র ৯০ মিনিট সময় লাগে। আর গাড়িতে ইসরায়েলের একদম উত্তরের শহর মেটুল্লা থেকে দক্ষিণের এইলাত পর্যন্ত যাত্রায় সময় লাগে প্রায় নয় ঘণ্টা।
ছবির উৎস,Getty Images
ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যা ৯৫ লক্ষ ১২ হাজার ৩৯৪ জন। প্রতি বর্গকিলোমিটারে সাড়ে চারশোরও কম মানুষ থাকে।
ইসরায়েল একটি ইহুদি রাষ্ট্র হলেও সেখানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অন্যান্য ধর্মের অনুসারীও বসবাস করেন। জার্মানির তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ‘স্ট্যাটিস্টা’ অনুযায়ী, জনসংখ্যার বিচারে দেশটিতে ইহুদীদের পরেই রয়েছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা।
এছাড়া, সেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খ্রিস্ট ও দ্রুজ ধর্মেরও মানুষ বসবাস করে।
স্ট্যাটিস্টা’র ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান বলছে, তখন ইসরায়েলে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৭১ লাখের কিছুটা বেশি এবং মুসলিম ছিল প্রায় ১৭ লাখ ৭৪ হাজার। এই তুলনায় খ্রিস্টান (এক লাখ ৮০ হাজার ৫০০ জন) ও দ্রুজদের (এক লাখ ৫১ হাজার ৩০০ জন) সংখ্যা বেশ কম।
তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোয় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইহুদী আছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে, বিশ্বের মোট ইহুদীদের অর্ধেকের কিছুটা কম সংখ্যক মানুষ ইসরায়েলে বসবাস করে। বাকি প্রায় অর্ধেক বাস করে যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কানাডা, ফ্রান্সের মতো দেশেও কিছু সংখ্যক ইহুদী আছে।
তবে ইসরায়েলের মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের অধিকাংশই ফিলিস্তিনি আরব বংশোদ্ভূত। তারা বর্তমানে ইসরায়েলের নাগরিক হিসেবেই বসবাস করে।
ছবির উৎস,Getty Images
ইসরায়েলের রাজধানী কী? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আরও অনেক বিষয় এখানে উঠে আসবে। কারণ কাগজে-কলমে ইসরায়েলের রাজধানী জেরুজালেম এবং ইসরায়েল দাবি করে জেরুজালেমের ওপর তাদের সার্বভৌম অধিকার রয়েছে।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে তারা পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। এরপর থেকে তারা জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী বলে গণ্য করে। এ নিয়ে ১৯৮০ সালে ইসরায়েলে একটি আইনও পাস হয়।
সেই আইনে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের “অভিন্ন ও অখণ্ড রাজধানী” হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু যদিও অনেক দেশ জেরুজালেমকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।
তবে ইসরায়েল তার প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এবং বিচারিক কার্যক্রম জেরুজালেম থেকেই পরিচালনা করে থাকে। সেখানে ইসরায়েলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর অবস্থিত।
যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নেয়ার পর তা ফিলিস্তিনিদের মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ করেছিলো।
এর কারণ, ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী হিসেবে চায়।
ইসরায়েল বিষয়ক আলোচনায় বারবার ফিলিস্তিনের কথা উঠে আসছে।
কিন্তু ফিলিস্তিনকে দেশ হিসাবে সবাই স্বীকার করে না, জাতিসংঘও এটিকে স্বীকৃতি দেয়নি।
তবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি না মিললেও এই বিশ্ব সংস্থার ৭০ ভাগ সদস্য রাষ্ট্রই ফিলিস্তিনকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। (সাধারণ পরিষদের ১৯২ টি দেশের ১৩৪টি দেশ)।
২০১৫ সালের সেপেম্বরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের বাইরে ফিলিস্তিনি জাতীয় পতাকা উত্তোলনেরও স্বীকৃতি মিলে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বিকৃতি দেয় না। এসব দেশের অধিকাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, তবে এর বাইরে রয়েছে ভেনিজুয়েলা, কিউবা এবং উত্তর কোরিয়া।
ছবির উৎস,Getty Images
দেশটিতে প্রায় ৮০টি শহর রয়েছে।
সেখানকার ৯০ শতাংশ মানুষ শহর এলাকায় থাকে। এর মধ্যে সিংহভাগই আবার বড় শহরে থাকে, বাকিরা থাকে ছোট শহরে। মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের বসবাস গ্রামে।
ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শহর হলো জেরুজালেম। ২০২২ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, সেখানে প্রায় নয় লাখ ৭০ হাজার লোকের বসবাস।
তবে সবচেয়ে বেশি মানুষ থাকে মাত্র ইসরায়েলের ১৬টি বড় শহরে। সাধারণত কোনও এলাকায় বিশ হাজার জনের মানুষ বসবাস করলে সেটিকে সেখানে বড় শহর বলা হয়।
এই শহরগুলোর বেশিরভাগই ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান নগরী তেল আভিভের আশেপাশে।
ইসরায়েলের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত কেন্দ্র হলো এই তেল আভিভ। বিশ্বের অনেক দেশ জেরুজালেমে না, এখানেই তাদের দূতাবাস রাখে।
জেরুজালেম ও তেল আভিভ ছাড়াও হাইফা, রিশোন লে জিয়ন, পেতাহ টিকভা, বিয়ার শেভা, নাজারেথও দেশটির বেশ গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে বিবেচিত।
হাইফাকে ইসরায়েলের বন্দরনগরী ও শিল্পকেন্দ্র হিসাবে ধরা হয়।
ছবির উৎস,Getty Images
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিন ছিল তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। এটি মুসলিম, ইহুদী এবং খ্রিস্টান– এই তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র ভূমি হিসেবে বিবেচিত।
তখন ইউরোপে বসবাসকারী ইহুদীরা ব্যাপক বিদ্বেষ-নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। সেখান থেকেই ‘জায়নিজম’ বা ইহুদীবাদী আন্দোলনের শুরু। তাদের লক্ষ্য ছিল ইউরোপের বাইরে কেবলমাত্র ইহুদীদের জন্য একটি রাষ্ট্র পত্তন করা। ইহুদীবাদী আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইউরোপের ইহুদীরা দলে দলে প্যালেস্টাইনে গিয়ে বসত গাড়তে শুরু করে।
কিন্তু তাদের এই অভিবাসন স্থানীয় আরব এবং মুসলিমদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। সেসময় আরব এবং মুসলিমরাই ছিল সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এদিকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য কার্যত ভেঙ্গে পড়ে এবং, পরবর্তীতে প্যালেস্টাইনে তখন আরব জাতীয়তাবাদী এবং ইহুদীবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়। ইহুদী এবং আরব মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে।
এদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেভাবে লাখ লাখ ইহুদীকে হত্যা করা হয় (হলোকাস্ট), তার পর ইহুদীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চাপ বাড়তে থাকে।
তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ার পর যে ‘লিগ অব নেশনস’ গঠিত হয়েছিলো, তাদের পক্ষ থেকে ব্রিটেনকে ‘ম্যান্ডেট’ দেয়া হয় প্যালেস্টাইন শাসন করার।
কিন্তু পরদিনই মিশর, জর্দান, সিরিয়া এবং ইরাক মিলে অভিযান চালায় ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে থাকা অঞ্চলে। সেটাই ছিল প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ।
ইহুদীদের কাছে এটি স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনে আরবদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে অঞ্চলটি বরাদ্দ করেছিল, এই যুদ্ধের পর তার অর্ধেকটাই চলে যায় ইসরায়েল বা ইহুদীদের দখলে। ফিলিস্তিনের জাতীয় বিপর্যয়ের শুরু সেখান থেকে।
ছবির উৎস,AFP
এটিকেই তারা বলে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়। প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে হয়। ইহুদী বাহিনী তাদেরকে বাড়ি-ঘর থেকে উচ্ছেদ করে।
ওই যুদ্ধ ছিল ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতের সূচনা মাত্র।
মাঝে অনেকগুলো বছর কেটে গিয়ে এলো ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ।
পাঁচই জুন হতে ১০ই জুন পর্যন্ত এই যুদ্ধে যা ঘটেছিলো, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল পরবর্তীকালে। ইসরায়েল বিপুলভাবে জয়ী হয় এই যুদ্ধে।
তারা তখন একদিকে মিশরের নিয়ন্ত্রণে থাকা গাজা ও সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয়। অন্যদিকে, পূর্ব জেরুসালেম-সহ পশ্চিম তীরও তারা দখল করে নেয় জর্ডানের কাছ থেকে। সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করে গোলান মালভূমি।
ফলাফলে আরও পাঁচ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়ি-ঘর ফেলে পালাতে হয়।
আরব-ইসরায়েল সংঘাতের ইতিহাসে এর পরের যুদ্ধটি ‘ইয়োম কিপুর’ যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরের এই যুদ্ধের একদিকে ছিল মিশর আর সিরিয়া, অন্যপক্ষে ইসরায়েল।
মিশর এই যুদ্ধে সিনাই অঞ্চলে তাদের কিছু হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করে। তবে গাজা বা গোলান মালভূমি থেকে ইসরায়েলকে হটানো যায়নি।
কিন্তু এই যুদ্ধের ছয় বছর পর ঘটলো সেই ঐতিহাসিক সন্ধি। মিশর প্রথম কোন আরব রাষ্ট্র যারা ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করলো। এর পর তাদের পথ অনুসরণ করলো জর্ডান।
কিন্তু তাই বলে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ শেষ হলো না, যা এখনো চলছে।