বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:১৯ অপরাহ্ন

ইমিগ্রেশনে ভয়াবহ প্রতারণা

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৫ মে, ২০২৩

‘ল্যান্ড অব অপর্চুনিটি’র দেশ আমেরিকা। এই প্রবাদ বাক্যের বিপরীতে আরেকটি প্রবাদ হলো- ‘আমেরিকা বেশিরভাগের জন্য সুযোগের দেশ, সবার জন্য নয়।’ কিন্তু প্রায় সবাই প্রথম প্রবাদ ‘ল্যান্ড অব অপর্চুনিটি’র সুযোগ নিচ্ছেন হরহামেশাই। আর এই সুযোগ নিতে গিয়ে অনেকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করার সময় প্রতারণামূলক কৌশল অবলম্বন করছে, যা ‘সুযোগের দেশ’ হিসাবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের সুনামকে কলঙ্কিত করেছে। সম্প্রতি রাজনৈতিক আশ্রয়ের (অ্যাসাইলাম) নামে ভয়াবহ প্রতারণার অভিযোগে আটজন বাংলাদেশির আবেদন ‘অ্যাম্বেসি রিভিউ’তে পাঠানো হয়েছে।

নিভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি একজন নারী প্যারালিগ্যালের মাধ্যমে যারা বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন, তাদের আবেদন রিভিউ করা হচ্ছে। এসব আবেদনকারীর অনেকের যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদন গৃহীত হয়েছে। পরবর্তীতে তারা গ্রিনকার্ডও পেয়েছেন। সূত মতে, যুক্তরাষ্ট্র কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন সাভিস (ইউএসসিআইএস) ওই প্যারালিগ্যালের মাধ্যমে করা আটজনের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনে বড় ধরনের অসঙ্গতি পেয়েছে। আটজনের কেস হিস্ট্রি একইরকম। অর্থাৎ নামের পরিবর্তন ছাড়া আর সবকিছুতে মিল রয়েছে।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ইমিগ্রেশন বিভাগে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনে অনুসন্ধান শুরু করেছে। তাদের আবেদনপত্র অ্যাম্বেসি রিভিউ’র জন্য ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে। দূতাবাস আবেদনকারীর সত্যতা মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান করে একটি প্রতিবেদন দেবে। দূতাবাসের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করছে আবেদনকারীদের ভাগ্য।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আবেদনকারী ঠিকানাকে জানান, তিনি ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর একজন পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে একজন নারী প্যারালিগ্যালের মাধ্যমে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। এজন্য ওই প্যারালিগ্যালকে ৮ হাজার ডলার দেওয়ার কথা রয়েছে। গত ১০ বছরে তিনি প্রায় ৬ হাজার ডলার দিয়েছেন। প্রথমেই ইমিগ্রেশন অফিস থেকে আবেদন প্রত্যাখাত হয়েছে। এরপর আদালতের শরণাপণ্ন হয়েছেন। সেই থেকে মামলা চলছে। সম্প্রতি আদালত ইমিগ্রেশন বিভাগের মাধ্যমে তার আবেদন অ্যাম্বেসি রিভিউতে পাঠিয়েছে। এতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।

ওই আবেদনকারী জানান, উন্নত জীবনের আশায় যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছি। দেশে তার জীবন ঝুুঁকির মধ্যে ছিল। দুইবার তার গ্রামের বাড়িতে হামলা হয়েছে। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র জমা দিতে গিয়ে প্যারালিগ্যালের পরামর্শে তিনি সামান্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। এটিই এখন তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে সূত্র জানায়, ওই নারী প্যারালিগ্যালের যে আটটি আবেদনপত্র রিভিউতে পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে একজন সাংবাদিক রয়েছেন, যিনি তার রাজনৈতিক আবেদনে বলেছেন, তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে দেশ ছেড়েছেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ইমিগ্রেশন বিভাগ ছয় বছর আগে ওই সাংবাদিকের আবেদন অনুসন্ধান করে জানতে পারে যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বিটে কাজ করেছেন তিনি। সরকারের অনেক মন্ত্রী ও নেতার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। ইমিগ্রেশন বিভাগ বর্তমানে তার আবেদন স্থগিত করে রেখে অ্যাম্বেসি রিভিউ’র জন্য পাঠিয়েছে। আবেদন মিথ্যা প্রমাণিত হলে ওই সাংবাদিক যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিস্কার হতে পারেন।

এদিকে আরেকজন বাংলাদেশির রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন রিভিউ করতে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন বিভাগ। ওই বাংলাদেশি ভারতীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করে ২০১৬ সালে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ ভিসায় আসেন। কোনো বোনাফাইড ব্যবসা না থাকলেও মানি লন্ডারিং তার মূল পেশা। আর অর্থের জোরে তিনি বাংলাদেশি কমিউনিটিতে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা সমাজসেবক বনে গেছেন। কমিউনিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লোক দেখানো অনুদান দিচ্ছেন। কমিউনিটির বিশিষ্টজনদের সঙ্গে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করছেন। ইমিগ্রেশন বিভাগ বর্তমানে তার দেওয়া তথ্য খতিয়ে দেখছে।

যুক্তরাষ্ট্র হোমল্যান্ড সিকিউরিটির তথ্য অনুযায়ী, ভূয়া বা মিথ্যা তথ্য প্রমাণিত হলে ভূয়া আবেদনকারীকে শুধু যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিস্কার নয়, গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ইমিগ্রেশন প্রতারণা একটি ফৌজদারী অপরাধ। আর এই অপরাধের শাস্তি সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ বছর পর্যন্ত জেল এবং সর্বোচ্চ আড়াই লাখ ডলার জরিমানা।

একাধিক সূত্র জানায়, আমেরিকায় যত বাংলাদেশি রয়েছেন, বেশিরভাগই বাস করেন নিউইয়র্কে। এছাড়া কারো ইমিগ্রেশন তথ্য চাওয়া নিউইয়র্ক সিটির আইন দ্বারা রহিত হওয়ায় আনডকুমেন্টেড অনেকেই বিশ্বের এই রাজধানীকে বেছে নিচ্ছেন। এ সুযোগে বাংলাদেশি বহু প্যারালিগ্যাল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যারা কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হয়েও বড় বড় মামলা ফাইল করছেন। মামলা জেতার গ্যারান্টিও দিচ্ছেন। ভাষা দুর্বলতার কারণে বহু বাংলাদেশি এসব বাংলাদেশি প্যারালিগ্যালের দ্বারস্থ হচ্ছেন। মিথ্যা তথ্য দিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার ফাইল করছেন। ফলে বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে তাদের প্রার্থনা। অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন দেশটিতে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অ্যাটর্নি এই প্রতিবেদককে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন বিভাগকে ধোকা দিয়ে দেশটিতে স্থায়ী নিবাস গড়ছেন অনেকে। ইমিগ্রেশন প্রতারণা ধরতে প্রতিনিয়ত কঠোর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে স্বজাতি নিয়োগ দিয়ে স্ব স্ব দেশের প্রতারকদের ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে বিশ্বের প্রধান পরাশক্তি দেশ যুক্তরাষ্ট্র। আর এতে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
যুক্তরাষ্ট্র কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন সার্ভিসের (ইউএসসিআইএস) প্রতারণা অনুসন্ধান এবং জাতীয় নিরাপত্তা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০১৬ সাল থেকে ফেডারেল এই দুই প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে ইমিগ্রেশন প্রতারণা রোধে কাজ করছে।

ইউএসসিআইএস-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে আসার জন্য মিলিয়নের বেশী আবেদন জমা পড়ছে। এরমধ্যে বছরে গড়ে ৩০ হাজার আবেদনে মিথ্যা তথ্য প্রদান বা প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়। একটি পরিসংখ্যান বলছে- বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ইমিগ্রেশন প্রতারণায় শীর্ষে রয়েছে ৮টি দেশ, যথাক্রমে চীন, ভারত, ঘানা, ভারত, কেনিয়া, মেক্সিকো, মরক্কো, নাইজেরিয়া ও পাকিস্তান। এরপরই সম্প্রতি উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। যে মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশিদের ভিজিট ভিসা সহজ করে দিয়েছে, ঠিক তখনই নানাভাবে প্রতারণা বেড়েছে।

একটি সূত্র জানায়, ভিসাপ্রাপ্তি সহজ হওয়ায়, বিশেষ করে স্টুডেন্ট ভিসার শর্ত শিথিল করায় অনেকে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন। ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে করা ভিসা আবেদনে ভূয়া তথ্য দিচ্ছেন। বর্তমানে স্টুডেন্ট ভিসার জন্য কমপক্ষে ৪০ লাখ টাকা ব্যাংক ব্যালেন্স দেখাতে হয়। এক্ষেত্রে কিছু ব্যাংক অর্থের বিনিময়ে মিথ্যা স্টেটমেন্ট দিচ্ছে। পরে দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যাংকের তথ্য নিশ্চিত করতে গিয়ে জানতে পারে প্রতারণার বিষয়টি।

নিউইয়র্কে অ্যাক্সিডেন্ট ও ইমিগ্রেশন অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঠিকানাকে বলেন, শুধু রাজনৈতিক আবেদন নয়, ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে আবেদনকারীকে সতর্কতা অবলম্বর করা উচিত। যদি কেউ মিথ্যা তথ্য দেন, তাহলে তিনি আজীবনের জন্য ভিসা পাবার অযোগ্য হতে পারেন। ছোটখাটো ভুল দূতাবাস মার্জনা করলেও প্রতারণার ব্যাপারে দূতাবাস জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে থাকে।

তিনি বলেন, অনেকে ফ্যামিলি মেম্বারদের যুক্তরাষ্ট্রে আনার ক্ষেত্রে অন্যের স্পন্সর ব্যবহার করে থাকেন। এক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে মঈন চৌধুরী বলেন, কার কাছ থেকে স্পন্সর নেওয়া হচ্ছে, কতজনকে তিনি স্পন্সর করছেন এসব তথ্য অবশ্যই জানতে হবে। স্পন্সরের কপি সংগ্রহে রাখতে হবে। ইদানিং দূতাবাস এসব তথ্য ভেরিফাই করছে। অতএব, আবেদনকারীরও স্পন্সর ভেরিফাই করা উচিত।

অ্যাসাইলাম আবেদনে ভুল তথ্য দেওয়া প্রসঙ্গে অ্যটর্নি মঈন চৌধুরী জানান, ভুল তথ্য দেওয়া প্রতারণার শামিল। তবে অ্যাসাইলামের ক্ষেত্রে কেস বাই কেস ভেরি করে। এজন্য প্রত্যেক আবেদনকারীর উচিত তার ঘটনা প্রথমে বাংলায় লেখা। জেনেবুঝে লেখা। এরপর আইনজীবী, প্রয়োজনে প্যারালিগ্যালের সাহায্য নেওয়া।

ঠিকানা

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com