একটি দেশের নাগরিকের প্রথম পরিচয় পাসপোর্ট। আন্তর্জাতিক ভ্রমণে এর গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এটি জাতীয় পরিচয় বহন করে। ফলে আন্তর্জাতিক যে কোনো ভ্রমণের ক্ষেত্রে তা না হলেই নয়। এক কথায় এর কোনো বিকল্প নেই। আর সেই পাসপোর্ট যদি হয় বিশ্বের ক্ষমতাধর পাসপোর্টের একটি তা হলে এ রকম সুযোগ হাত ছাড়া করতে কে বা চায়। বিশ্বের সেই শক্তিশালী পাসপোর্ট হল ইউরোপিয়ানইউনিয়নভুক্ত দেশ ইতালির লাল পাসপোর্ট। এ একটি লাল পাসপোর্ট পেতে জীবন-যৌবন পার করে দিয়েছেন অসংখ্য বাংলাদেশি। বছরের পর বছর অতিক্রম করেও অনেকেই লাল পাসপোর্টটি পাননি। যদিও সময় বয়স দুটোই চলে যায়। যৌবনের শেষ সময়টুকু পর্যন্ত স্বপ্নের দেশ ইতালিতে কেটে গেল। তবু সেই আশা পূরণ হল না। পাসপোর্ট পেতে আইনের প্যাঁচে পড়ে লম্বা সময় বেঁধে দেয়ার ফলে টগবগে যুবক থেকে অনেকেই বৃদ্ধ হয়ে যান। কেউ বার্ধ্যকে চলে গেছেন কেউ আবার না ফেরার দেশে। এভাবেই লাল পাসপোর্ট পাওয়ার প্রতীক্ষা করে জীবন-যৌবন শেষ করে দিচ্ছেন বাংলাদেশিরা। এর মধ্যে যেসব বাংলাদেশি দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা করে নিয়ম মেনে আবেদন করেছেন। অনেকেই লাল পাসপোর্ট পেয়ে বিশ্বকে পেয়েছেন হাতের মুঠোয়। কিন্তু লাভ কী যৌবন যে শেষ হয়ে যায়। লাল পাসপোর্ট পেতে সময় লাগে একযুগ।
ইউরোপে আসার সাধ কার না জাগে। সবাই আসতে চায় ইউরোপ; এক নজর দেখতে। আর যারা বিভিন্ন উপায়ে ইতালি পাড়ি জমিয়েছেন, স্থায়ীভাবে থেকে নিজেকে স্বাবলম্বী করেছেন ইতালিতে তাদের বিচিত্রভাবে সময় কাটে। ইতালিতে প্রথম প্রবেশ করার পর ওইদিন থেকে তাকে দশ বছর গুনতে হয় একটি লাল পাসপোর্ট পেতে। এর আগে স্টে পারমিট (ইতালিয়ান ভাষায় সৌজন্য) পাওয়ার পরপরই পাসপোর্ট পেতে একটি স্থায়ী ঠিকানা করতে হয়। এ স্থায়ী ঠিকানার মেয়াদ দশ বছর হওয়ার পর আইনগতভাবে নাগরিকত্ব পেতে আবেদন করতে পারেন যে কোনো অভিবাসী। এর একদিন আগেও আবেদন গ্রহণযোগ্য হয় না। এরপর নাগরিকত্ব প্রত্যাশী অভিবাসীকে নিয়মিত কাজ, বার্ষিক আয়ের হিসাব-নিকাশ দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রতারণার সঙ্গে জড়িত না হওয়া, অকারণে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত না থাকা, দেশদ্রোহী কোনো কাজে সম্পৃক্ত না হওয়া এসব শর্ত অভিবাসী অফিসে যাচাই-বাছাই করার পর, সব ঠিক থাকলে আবেদনের পর আঠার থেকে দুই বছর লাগে পাসপোর্ট হাতে পেতে। কিন্তু ইতালির সাবেক সরাষ্ট্র মন্ত্রী কট্টর অভিবাসী বিরোধী মাত্তে সালভিনি দুই বছরের পরিবর্তে চার বছর করেন জমা দেওয়ার পর একজন অভিবাসীকে চার বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এভাবে পাসপোর্ট পেতে একজন অভিবাসীর প্রায় ১৪ বছর লেগে যায়। বয়স অনুপাতে অনেকে পাসপোর্ট পেয়েও কোন কাজ করতে পারেনা। যদি কারো বয়স ৪০ বছর হয় তার সাথে আরও ১৪ বছর যোগ হলে বয়স দাঁড়ায় ৫৫ বছর। বাংলাদেশের বর্তমানে বাংলাদেশের নাগরিকদের ২০১৯ সালের হিসাবে গড় আয়ু ৭২.৬ এর আগে ২০১৮ ছিল ৭২.৩ বছর। সেই দিক বিবেচনা করলে এ পাসপোর্ট ব্যবহারের সময়টা পর্যাপ্ত পাওয়া যায়না। অর্থাৎ বেশি একটা লাভবান হওয়া যাচ্ছেনা।
একটি লাল পাসপোর্ট পেতে একজন বাংলাদেশিকে একযুগেরও বেশি অপেক্ষা করতে হয়। এর আগে পাসপোর্ট প্রত্যাশীকে শপথবাক্য পাঠ করতে ডাকা হয় অভিবাসী অফিসে। এ সোনার হরিণ ধরতেই অবৈধ-বৈধভাবে বাংলাদেশিরা ইতালিতে আসতে মরিয়া হয়ে উঠেন। কেউ পাড়ি দেন আটলান্টিক মহাসাগর কেউ বা ভূমধ্য মহাসাগর। কারো হয় জয় কারো আবার পরাজয়। ঝড়ে যায় অনেক প্রাণ সাগরের মাঝে। তবু থেমে নেই ইউরোপের সোনার হরিণ ধরতে আসা বাংলাদেশিসহ অন্যান্য অভিবাসীরা। প্রডি বছর লিবিয়ার ত্রিপোলি হয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির লামপোদোসা নাক স্থানে আসতে চেষ্টা করে এরমধ্যে অনেকের সলিল সমাধি হয় গভীর সাগরের মাঝে। এত বড় জীবম ঝুঁকি নিয়ে
স্বপ্ন গড়ার জন্য সাগর পাড়ি জমান। এরপর অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে কোন ভাবে বৈধতা পেলে আস্তে আস্তে একটা সময় সবুজ পাসপোর্টের সাথে লাল পাসপোর্টের পাওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। কারন
এই লাল পাসপোর্টটি এর আগে বিশ্বের মাঝে ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে তৃতীয় একটি অবস্থান দখল করে ছিল তবে বর্তমানে এর অবস্থান চতুর্থ।
সেনজেনভুক্ত ২৭টি রাষ্ট্র ভিসামুক্ত করা হয়েছে। ইতালির ভিসা (সেনজেন) কোনো পাসপোর্টে থাকা মানে আটাশটি দেশ নিশ্চিন্তে আরামদায়ক ভ্রমণ করা যাবে। তাই পাসপোর্টটির জন্য সবার আগ্রহ একটু বেশি। এছাড়া গেøাাবাল র্যাংকিং স্কোর হিসেবে এর অবস্থান ১৫৭। ভিসামুক্ত ভ্রমণ ১২৪ দেশে। ভিসাসহ ভ্রমণ ৩২টি দেশ। ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন ১৫ জানুয়ারি ২০১৬ একটি প্রতিবেদনে ইতালিয়ান পাসপোর্ট ছিল পৃথিবীতে এক নম্বর। অর্থ সমৃদ্ধিশালী আর দীর্ঘ সময় প্রতীক্ষার পর সোনার হরিণ পাওয়ার আশায় বসে থাকে বছরের পর বছর প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশিসহ অন্য দেশের অভিবাসীরা। ইতালিতে সাদা-কালো মানুষের বৈষম্য থাকলেও ইউরোপের একমাত্র মানবাধিকার দেশ যেখানে সহজে কোনো অবৈধকে নিজ দেশে ফেরত পাঠায় না। যার ফলে বিভিন্ন দেশের মানুষ এ দেশটিকে ইউরোপে প্রবেশের জন্য ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে।
অন্যদিকে দেশটি মানবতার জন্য বড় একটি দৃষ্টান্ত ইউরোপে। যেখানে রয়েছে খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় ধর্মশালা যা গোটাবিশ্ব এক নামে চেনে ভ্যাটিকেন শহর। অন্যভাবে বলা যায় একটি দেশের ভেতরে আরেকটি ছোট্ট দেশ। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক দল ছুটে আসে ভ্যাটিকেন শহরটি এক নজর দেখতে। যার ফলে ভ্যাটিকানে পর্যটকদের আনাগোনা অনেক বেশি থাকে। এরকম একটি সমৃদ্ধশালী দেশে বাংলাদেশিদের বসবাস কয়েক যুগ ধরে। হাজারও বাংলাদেশি পেয়েছে দেশটির নাগরিকত্ব।
জমির হোসেন, ইতালি থেকে