আর্মেনিয়ার সরকারী নাম “রিপাবলিক অফ আর্মেনিয়া”। এটি ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যবর্তী ইউরেশিয়ার দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে অবস্থিত একটি স্থলবেষ্টিত দেশ। দেশটির উত্তরে জর্জিয়া, দক্ষিণে ইরান, পূর্বে আজারবাইজান এবং পশ্চিমে তুরস্ক অবস্থিত।
বিশ্ব পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক দেশের নাম আর্মেনিয়া। দেশটি আয়তনে তেমন বড় না হলেও এর রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। প্রকৃতির লীলাভূমি আর্মেনিয়ার সৌন্দর্য তার ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মতোই সমৃদ্ধশালী। বিশ্বের প্রাচীন সংস্কৃতি আর সভ্যতা দেখার জন্য প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু পর্যটক আর্মেনিয়া ভ্রমণে আসেন। এই দেশটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যও বিখ্যাত।
তাহলে চলুন আজকে আর্মেনিয়া দেশ সম্পর্কে আরো কিছু জানা-অজানা এবং প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
। আর্মেনিয়ার চারপাশে ঘিরে আছে বেশ কয়েকটি শক্তিশালী দেশ। ফলে দেশটিকে বার বার বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হতে হয়েছে। রোমান, বাইজান্টাইন, আরব, তুরস্ক, পারস্য, মঙ্গোল, জর্জিয়া, রাশিয়ার মধ্যে পালাক্রমে হাতবদল হয়েছে দেশটি। দেশটির পশ্চিমাংশ দীর্ঘদিন অটোম্যান সাম্রাজ্যের দখলে ছিল। সে সময় তুর্কিরা আর্মেনীয়দের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। এই ভয়ঙ্কর গণহত্যা থেকে নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য তারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আশ্রয় নেয়। আর এভাবেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আর্মেনীয়দের বসতি গড়ে ওঠে। সবশেষে ১৯৯১ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর আর্মেনিয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
২। ২৯ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটিতে মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। আয়তনের দিক দিয়ে এটি বিশ্বের ১৩৮ তম দেশ।
৩। আর্মেনিয়ার সরকারী ভাষা আর্মেনীয় ভাষা। দেশটির ৯৮ শতাংশ অধিবাসী আর্মেনীয় ভাষায় কথা বলে থাকেন। একইসাথে দেশটির প্রায় ৯০% মানুষ আর্মেনীয় ও রুশ উভয় ভাষাতেই স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারেন। তবে ইদানিং দেশটিতে ইংরেজির আধিপত্য বেড়েছে।
৪। খ্রিস্টানধর্ম দেশটির প্রায় ৯৫ শতাংশ অধিবাসীর ধর্ম। ৩০১ খ্রিষ্টাব্দে আর্মেনিয়া ইতিহাসের প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে এবং আর্মেনীয় গির্জাব্যবস্থার পত্তন করে। দেশটিতে মুসলমানদের সংখ্যা মাত্র হাজার ৩ এর মতো।
৫। ইয়েরেভান হল আর্মেনিয়ার রাজধানী এবং সবচেয়ে বড় শহর। এটি আর্মেনিয়ার প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। একই সাথে এটি বিশ্বের অন্যতম পু্রোনো, সর্বদা জনবসতিপূর্ণ, লোকসমাগম থাকা শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম।
এটি আর্মেনিয়ার এক ঐতিহাসিক শহর। এই শহরকে ভালভাবে জানতে পারলেই পুরো দেশটি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। শহরের কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত আর্মেনিয়ান গণহত্যার স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শন করলে একটি জাতির বেঁচে থাকার এক রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। শহরের প্রধান আবোভিয়ান স্ট্রিট ধরে হেঁটে যেতে যেতে প্রাচীন আর্মেনীয় সংস্কৃতির নানা ছবি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। শহরটির পথে পথে ছড়িয়ে রয়েছে ছোট-বড় ক্যাফে আর রেস্তোরাঁ। শহরটি অনেকের কাছে ক্যাফে অব সিটি হিসেবেও পরিচিত। এই শহরেই দেশটির একমাত্র মসজিদ ব্লু মস্ক অবস্থিত।
৬। দেশটিতে একটি উচ্চভূমি মহাদেশীয় জলবায়ু বিদ্যমান। এখানে গ্রীষ্মকাল গরম, শুকনো এবং রোদেলা থাকে, যা জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এসময় তাপমাত্রা ২২-৩৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। কিন্তু শীতকালে তাপমাত্রা কমে -১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়।
৭। আর্মেনিয়ার রাজনীতি একটি রাষ্ট্রপতিশাসিত প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের কাঠামোয় পরিচালিত হয়। প্রেসিডেন্ট হলেন সরকার প্রধান এবং বহুদলীয় ব্যবস্থার একটি দলেরও প্রধান তিনি।
৮। ৩৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ও সর্বোচ্চ ৭২.৫ কিলোমিটার প্রস্থবিশিষ্ট সেভান হ্রদ আর্মেনিয়ার ভূগোলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হ্রদটি সমুদ্রতল থেকে ২০৭০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত।
৯। দেশটির রাজধানী শহরে “বাংলাদেশ” নামে একটি জনবসতি রয়েছে। তবে শহরের বিলবোর্ডগুলোতে ইংরেজি বানানের ‘বাংলাদেশ’ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবকিছু আর্মেনিয়ান ভাষায় লেখা।
এলাকাটির অফিসিয়াল নাম ‘মালাতিয়া সেবাস্তিয়া’। তবে আনুষ্ঠানিক নাম এটি হলেও স্থানীয়দের কাছে ‘বাংলাদেশ’ নামেই পরিচিত। পরিবহন, দোকানপাট, আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট সবাই এই নামেই চেনেন। তবে কেন এই এলাকার নাম বাংলাদেশ, তা সঠিক কেউ বলতে পারেন না। ধারনা করা হয় এই এলাকার নাম ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ইয়েরেভানের সবচেয়ে বড় বাজার এই ‘বাংলাদেশ’ এলাকাতেই অবস্থিত।
১০। আর্মেনিয়া বিশ্বের একজাতীয় দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশটির প্রায় ৯৭ শতাংশ মানুষই জাতিগতভাবে আর্মেনীয়।
১১। বিশ্বের প্রথম চার্চটি আর্মেনিয়ায় নির্মিত হয়েছিল। হলি এথিমিয়াডজিন চতুর্থ শতাব্দীর প্রথম দিকে পৃথিবীতে নির্মিত প্রথম রাষ্ট্রীয় গীর্জা ছিল। বর্তমানে এই স্থানটি আর্মেনিয়ার সমস্ত গীর্জার সদর দফতর এবং এটি বিশ্বের অন্যতম দর্শনীয় তীর্থস্থান।
১২। অটোমান শাসনের সময় আর্মেনিয়া পদানত হয়। তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় খ্রিস্টানদের ওপর। পৃথিবীর নৃশংস গণহত্যার মধ্যে আর্মেনিয়ার গণহত্যা ছিলো ভয়ানক। এসময় প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়।
১৩। আর্মেনিয়াতে নগরায়নের হার উচ্চ। এখানে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক শহরে বাস করে। নদী উপত্যকায়, বিশেষত হ্রাজদান নদীর তীরে বসতির ঘনত্ব বেশি। এই হ্রাজদান নদীর তীরেই আর্মেনিয়ার বৃহত্তম শহর ও রাজধানী ইয়েরেভান অবস্থিত।
১৪। দেশটিতে শিক্ষার হার ১০০ শতাংশ। এখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা একদম ফ্রি এবং মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক।
১৫। দেশটিতে বাস্কেটবল, ফুটবল ও টেনিস জনপ্রিয় খেলা। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে আর্মেনীয়রা কুস্তি, মুষ্টিযুদ্ধ, ভারোত্তোলন এবং জিমন্যাস্টিক্সে সাফল্য লাভ করেছে।
১৭। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর আর্মেনিয়াতে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলেও দেশটি ধীরে ধীরে তা কাটিয়ে উঠছে। বর্তমানে দেশটির অর্থনীতি বিদেশী বিনিয়োগ এবং সহায়তার উপর প্রচুর নির্ভর করে। তবে দেশটির মূল অর্থনৈতিক খাতগুলোর মধ্যে মাইনিং, নির্মাণ খাত, শক্তিৎপাদন, শিল্প ক্ষেত্র, সেবা খাত উল্লেখযোগ্য।
১৮। আর্মেনিয়ার সরকারী মুদ্রা ড্রাম। ১ আর্মেনিয়ান ড্রাম সমান প্রায় বাংলাদেশী ১৮ পয়সা এবং ০.১৫ ভারতীয় রুপী।
১৯। দেশটির মোট জিডিপি প্রায় $৩২.৮৯৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং মাথাপিছু আয় প্রায় $৪,৪৪৬ মার্কিন ডলার।
২০। আর্মেনিয়ার ডায়ালিং কোড হচ্ছে +৩৭৪।