তাহলে বন্ধুরা চলুন, আর্জেন্টিনা সম্পর্কে আরো কিছু জানা-অজানা এবং প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
১। আর্জেন্টিনাতে আদি প্রস্তর যুগে মানব বসতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। আধুনিক আর্জেন্টিনার ইতিহাস ১৬শ শতকে স্পেনীয় উপনিবেশীকরণের মাধ্যমে সূচিত হয়। ১৭৭৬ সালে এখানে স্পেনীয় সাম্রাজ্যের অধীনে রিও দে লা প্লাতা উপরাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এই উপরাজ্যের উত্তরসূরী রাষ্ট্র হিসেবে আর্জেন্টিনার উত্থান ঘটে। প্রায় তিন শতাব্দী ধরে ঔপনিবেশিক শাসনের পর ১৮১০ সালে আর্জেন্টিনা স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৮১৮ সালে স্পেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধবিজয় শেষ হয়।
এরপরে দেশটিতে অনেকগুলি গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮৬১ সালে অনেকগুলি অঙ্গরাজ্যের একটি ফেডারেশন হিসেবে দেশটি পুনর্গঠিত হয়, যার রাজধানী নির্ধারিত হয় বুয়েনোস আইরেস। এর পরে দেশটিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফেরত আসে এবং ইউরোপ থেকে বিপুলসংখ্যক অভিবাসীর আগমন ঘটে, যার ফলে সাংস্কৃতিক ও জনসংখ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে দেশটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
২। ২৭ লাখ ৮০ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটিতে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষের বসবাস।
৩। দেশটির সরকারী ভাষা স্প্যানিশ। তবে ইংরেজি ভাষাও দেশটিতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত।
৪। আর্জেন্টিনার অধিকাংশ মানুষ রোমান ক্যাথলিক ধর্মের অর্থাৎ খ্রিস্টধর্মের অনুসারী। দেশটির প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষ এই ধর্মে বিশ্বাসী।
৫। আর্জেন্টিনার রাজধানী এবং সবচেয়ে বড় শহর বুয়েনস আইরেস। এটি দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ ও আন্তর্জাতিক শহরগুলির একটি। উচ্ছ্বল রাত্রিজীবন এবং স্থাপত্যশৈলীর কারণে এটিকে প্রায়ই প্যারিস ও রোমের সাথে তুলনা করা হয়। বৃহত্তর বুয়েনস আইরেস এলাকাতে আর্জেন্টিনার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জনগণ বাস করে।
৬। আর্জেন্টিনাতে বৈচিত্র্যময় আবহাওয়া বিরাজমান। তবে মোটা দাগে বলতে গেলে, দেশটিতে আর্দ্র গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়া বিরাজমান। দেশটিতে সবচেয়ে উষ্ণ মাস হচ্ছে জানুয়ারি। এই সময় দেশটিতে গড়ে তাপমাত্রা থাকে ২৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আর শীতকালে দেশটিতে গড় তাপমাত্রা থাকে ১৬ ডিগ্রীর আশেপাশে।
৭। ১৯১৩ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বের ১০ম ধনী রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছিল, যাদের অবস্থান এখন বিশ্বে ৫৩ তম।
৮। আর্জেন্টিনা বিশ্বের অন্যতম শিক্ষিত দেশ হিসাবে পরিচিত।
৯। দেশটিতে দুপুরের খাবারের পর সিয়েস্তা নামে একটি প্রথা প্রচলিত আছে। “সিয়েস্তা” আর কিছুই না, দুপুরের খাবারের পরের ঘুমকেই দেশটিতে সিয়েস্তা বলা হয়ে থাকে। যা আমাদের উপমহাদেশেও একটি অতি প্রচলিত ঘটনা। তবে দেশটিতে ঐ নির্দিষ্ট সময় বেশিরভাগ শিক্ষা এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। রাজধানী শহরে এমন কয়েকটি হোটেল রয়েছে যারা বিশেষত সিয়েস্তার জন্য রুম ভাড়া দিয়ে থাকে।
১০। কুইরিন ক্রিসটিনি নামে একজন আর্জেন্টাইন ১৯১৭ সালে “এল এপোস্টোল” নামের প্রথম অ্যা্নিমেসন চলচিত্রটি তৈরি করেছিলেন। চলচ্চিত্রটি ৭০ মিনিট দীর্ঘ ছিল এবং এতে ফ্রেম সংখ্যা ছিল ৫৮ হাজার।
১১। এই দেশেই সর্বপ্রথম অপরাধী শনাক্ত করতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট শনাক্তকরন ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়।
১২। “আর্জেন্টিনা” শব্দটি লাতিন শব্দ “সিলভার” থেকে এসেছে। মূল ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা বিশ্বাস করত যে দেশটি রূপা দিয়ে পূর্ণ। তবে দুর্ভাগ্যবশত, দেশটিতে কখনোই কোন রূপা পাওয়া যায় নি।
১৩। দেশটিতে রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য, ক্রমবর্ধমান কৃষি খাত এবং সমৃদ্ধ শিল্পখাত।
১৪। ২০০১ সালে, আর্জেন্টিনায় ১০ দিনে ৫ জন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল।
১৫। বেশিরভাগ আর্জেন্টাইন নিজস্ব গাড়ী ব্যবহার না করে গনপরিবহনে যাতায়াত করেন।
১৬। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে আর্জেন্টিনাতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়, যাদের বেশিরভাগই সেই সময় দেশের ক্ষমতায় থাকা সামরিক জান্তার দ্বারা খুন হয়।
১৭। আর্জেন্টিনার অবসর প্রাপ্ত বিখ্যাত ফুটবলার ডিয়েগো মেরাডোনার নামে দেশটিতে একটি ধর্ম আছে যা তার ভক্তদের দ্বারা তৈরি।
১৮। আর্জেন্টাইন স্প্যানিশ ভাষায় টুথপেস্ট “কোলগেট” এর অর্থ হচ্ছে “নিজেকে ফাঁসিতে ঝুলানো”।
১৯। বিশ্বের মোট উদ্ভিদ প্রজাতির ১০ শতাংশ এই দেশটিতেই পাওয়া যায়।
২০। আর্জেন্টিনার প্রধান ফসল হচ্ছে গম। দেশটিতে আক্ষরিক অর্থেই প্রচুর পরিমানে গম উৎপন্ন হয় যা দেশটিকে বিশ্বের ৫ম বৃহত্তম গম রপ্তানিকারক দেশে পরিনত করেছে। দেশটিতে দক্ষিণ আমেরিকায় উৎপাদিত মোট গমের ৬০ শতাংশ উৎপন্ন হয়।
২১। আর্জেন্টিনা একই সাথে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম গরুর মাংস উৎপাদনকারী দেশ। দেশটি বছরে প্রায় ২.8 থেকে ৩.৫ মিলিয়ন টন মাংস উৎপাদন করে।
২২। আর্জেন্টিনাতে “পেরিটো মরেনো গ্লেসিয়ার” অবস্থিত। এটি শুধুমাত্র বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মিষ্টি পানির উৎসই নয়, এটি এমন একটি হিমবাহ যেটি গলে যাওয়ার বদলে দিনে দিনে বড় হচ্ছে।
২৩। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রাজপথ “জুলাই ৯ এভিনিও“ আর্জেন্টিনাতেই অবস্থিত। এই রাজপথটিতে মোট ১২ টি লেন রয়েছে।
২৪। ২০১৬ সাল পর্যন্ত, যদি কোন আর্জেন্টাইন বিদেশে ভ্রমণ করার জন্য ডলার কিনতে চাইত, তাহলে সে কোথায়, কখন এবং কেন ভ্রমণ করছে, সেটি উল্লেখ করে সরকারকে একটি আবেদন পাঠাতে হতো।
২৫। আর্জেন্টিনাতে প্রতি ব্যাক্তি গড়ে সপ্তাহে প্রায় ২০ ঘণ্টা রেডিও শোনেন, যা বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ।
২৬। ক্ষুধা মন্দার দিক দিয়ে আর্জেন্টিনার অবস্থান বিশ্বে ২য়, যাদের অবস্থান ঠিক জাপানের পরেই।
২৭। মেসির হোম টাউন এ বসবাসকারী সরকারী কর্মকর্তাদের তাদের ছেলেমেয়েদের নাম মেসি রাখা নিষিদ্ধ।
২৮। ১৯৭৭ সালে, এন্টার্কটিকা মহাদেশের একটি অংশ দাবি করার জন্য আর্জেন্টিনা সরকার একজন গর্ভবতী মা কে সেখানে পাঠিয়েছিল। ঐ ছেলেটি এন্টার্কটিকায় জন্ম গ্রহন করা প্রথম মানুষ হিসাবে পরিচিত।
২৯। কিউবান বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব, “আর্নেস্তো চে গুয়েভারা” আর্জেন্টিনাতে জন্মগ্রহণ করেন।
৩০। আর্জেন্টিনা ২০১০ সালে লাতিন আমেরিকার প্রথম দেশ হিসাবে সমকামী বিবাহর বৈধতা প্রদান করে।
৩১। আর্জেন্টিনাতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের তাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডের বিয়ার রয়েছে।
৩২। “রুফস হোরনেরো” আর্জেন্টিনার জাতীয় প্রাণী।
৩৩। ১৯৮৭ সাল থেকে আর্জেন্টিনাতে তালাক ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়েছে, এবং বর্তমানে দেশটিতে তালাকের হার সর্বোচ্চ।
৩৪। দেশটিতে ২০১২ সালে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে যার পিতা ছিল ২ জন। এবং শিশুটির বার্থ সার্টিফিকেটে পিতার নামের যায়গায় দুইজন পিতার নাম লিখা হয় যা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম।
৩৫। নিউইয়র্ক সিটির বাইরে বুয়েনস আইরেস এ আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম ইহুদি জনগোষ্ঠীর বাস।
৩৬। আর্জেন্টিনার কর্মীদের প্রায় ৪০ শতাংশ মহিলা এবং আর্জেন্টিনায় কংগ্রেসের আসনগুলির মধ্যে ৩০ শতাংশ নারী রয়েছে।
৩৭। আর্জেন্টিনা ফুটবলের নায়ক লিওনেল মেসি যুক্তিযুক্তভাবে বিশ্বের সেরা ফুটবলারদের একজন।
৩৮। আর্জেন্টিনার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হচ্ছে ফুটবল। দেশটি জাতীয় ফুটবল দল ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালে ফুটবল বিশ্বকাপ জিতেছে।
৩৯। আর্জেন্টিনার প্রায় ৩০ শতাংশ নারী তাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য প্লাস্টিক সার্জারী করে থাকেন।
৪০। আর্জেন্টিনার অর্থনীতি ল্যাটিন আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম এবং দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম।
৪১। দেশটির সরকারী মুদ্রা হচ্ছে পেসো।
৪২। ২০১৯ সালের এক হিসাবে দেশটির মোট জিডিপি $৪৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এবং মাথাপিছু আয় প্রায় ১০ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার।
৪৩। আর্জেন্টিনার ডায়ালিং কোড হচ্ছে +৫৪।
বন্ধুরা, আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকার সবগুলো দেশের মধ্যে অন্যতম সুন্দর একটি দেশ। দেশটির রাজধানী বুয়েনস আইরেস দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বেশি পরিদর্শিত শহর। প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটকের আগমন ঘটে দেশটিতে। যা দেশটির অর্থনীতিকেও আরো উন্নত করছে।