‘আংকেল আমরা বাই রোড আমেরিকা এসেছি।’ বাই রোড আমেরিকা বাংলাদেশ থেকে? রনির মুখে কথাটা শুনে অবাক হয়েছিলাম।
ছেলেটার সঙ্গে নিউইয়র্কে এক দোকানে আলাপ হয়েছিল। শ্রমিকের কাজ করত। বৈধ কাগজ ছিল না। কী করে যেন ছেলেটা আমার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। একদিন কথায় কথায় কেমন করে আমেরিকা এসেছে জিজ্ঞেস করাতে এক বিচিত্র জগতের কাহিনি মেলে ধরেছিল আমার সামনে।
‘সে এক লম্বা গল্প, আংকেল শোনার সময় হবে আপনার?’ ম্লান হেসে বলেছিল রনি। শুনেছিলাম রনির গল্প। কলম্বাসের দুঃসাহসিকতার গল্প, লোভ আর মোহের গল্প, অলীক স্বপ্নের গল্প। ছেলেটা পড়াশোনা বেশি করেনি। স্টুডেন্ট ভিসার চেষ্টা কয়েকবার করে ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে আমেরিকা যাওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা। ঢাকার আদম ব্যবসায়ী দালালদের মুখে মুখে নামটা ছিল আমেরিকা বাই রোড। আমেরিকা যেতে ইচ্ছুক ছেলেরাও বলে ‘বাই রোড আমেরিকা যাবে’। এ জন্য দালাল আছে। ঢাকা থেকে ব্রাজিলের ভিসা নিতে হয়। নিতে হয় দু-একটা ক্যারিবিয়ান দেশেরও টুরিস্ট ভিসা। তারপর এসে নামে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের কোনো এক দ্বীপে। সেখান থেকে লঞ্চে মেইনল্যাণ্ড, তারপর বাসে করে ব্রাজিলের সাও পাওলো।
কয়েক দিনের বাস জার্নি। এক এক জায়গা থেকে একেক দালাল হস্তান্তর করে অন্য দালালের হাতে। পরিচিতি শুধু ঢাকার দালালের দেওয়া মোবাইল ফোনে সেই দালালের ছবি। সেই দালাল আবার আরেকজন দালালের ছবি দিয়ে হস্তান্তর করে। ছোট ধরনের হোটেলে লুকিয়ে রাখা হতো তাদের। রনিও ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছিল ওভাবেই। সবকিছু, এমনকি খাবারও অনিশ্চিত। কখনো প্লেনে যাওয়া, প্লেন থেকে নেমে ফোনের ছবি মিলিয়ে আরেক দালালের হাতে নিজেকে সমর্পণ করা।
ব্রাজিল থেকে বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হণ্ডুরাস, গুয়াতেমালাসহ বিভিন্ন দেশের মধ্য দিয়ে যাওয়া। সঙ্গে দালাল থেকে দালালের হাতে নিজেকে হস্তান্তর করা। প্রথমেই টাকা দিতে হতো কথা মোতাবেক। টানা তিন দিন শুধু মাইক্রোবাসে করে চলেছে। কখনো দিনের পর দিন শুধু জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটা। গল্প শুনেছে আগের যাওয়া দলের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি আর। তাঁরা ডাকাতের হাতে না মানুষখেকোদের হাতে পড়েছিল কে জানে। অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরে মেরে ফেলেছে কিনা-তাও কেউ জানে না। কতবার কত দেশের পুলিশ নির্যাতন করেছে তারপর টাকা হাতিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। টাকা লুকিয়ে রাখার অভিনব সব পথ বের করেছিল ছেলেগুলো। একটা ছিল পলিথিনে ডলার নিয়ে নারকেল তেলের শিশির ভেতর ভরে রাখা। তেল জমে গেলে নিরাপদ। ঠান্ডার সময় তেল জমে যেত। তেল জমে গেলে পুলিশ বা চোর বুঝতে পারত না, ফলে টাকা রক্ষা পেত। আরও সব বিচিত্র পদ্ধতিতে তারা টাকা লুকিয়ে রাখত।
বললাম, এভাবে অবৈধভাবে আমেরিকা আসার কি কোনো যুক্তি ছিল? বৈধভাবে আসলে তো কোনো কথা থাকে না। মলিন হেসে বলে, ‘আগে বুঝিনি আংকেল। অনেকেই আসতে মানা করেছিল। অনিশ্চিত পথের ও ভবিষ্যতের কথা বলেছিল, বিশ্বাস করিনি। ভেবেছিলাম নিজে গেছে তো তাই আমাদের নিতে চায় না। মোহের চশমা চোখে দিয়ে দেখেছিলাম, আমেরিকা নামলে সব পেয়ে যাব, দালাল তাই বুঝিয়েছিল। ওয়ার্ক পারমিট, অ্যাসাইলাম, গ্রিন কার্ড, সিটিজেনশিপ একে একে সব হয়ে যাবে।
আমার বোন সুমি একটা মেয়ের গল্প বলেছিল। সামিনা নামের মেয়েটি চাকরি করে মাস্টার্স পড়তেন। গরিব ঘরের পরিশ্রমী মেয়ে। একটা কোম্পানিতে সেলসে কাজ করতেন। বিভাগীয় ম্যানেজার স্নেহ করতেন। আশ্বাস দিয়েছিলেন মাস্টার্স শেষ করলেই তাঁকে একটা প্রমোশন দেবেন। ওই কেনাকাটার সূত্রেই সুমির সঙ্গে আলাপ এবং কিছুটা ঘনিষ্ঠতা।
একই মহল্লাতে থাকার সূত্রে দেখা সাক্ষাৎ হতো মাঝে মাঝে। একদিন সামিনা লাজুক হেসে বললেন, ‘আপা, আমার বিয়ে হয়ে গেছে।’ অবাক হয় সিমু। সামিনা জানান, ‘না আপা, ও বিদেশ থেকে আসলে অনুষ্ঠান হবে, তখন অবশ্যই দাওয়াত দেব।’
—ছেলে আসলে, তো বিয়ে হলো কেমন করে? কোথায় থাকে ছেলে?
—ইতালিতে থাকে আপা। আমাদের পাশের গ্রামের ছেলে। ফেসবুকে আলাপ হয়েছিল।
—বলো কী সামিনা, ফেসবুকের আলাপে টেলিফোনে বিয়ে করে ফেললে?
—জি আপা, ছেলেটা খুব ভালো। আসবে সামনের বছর।
—তখনই না হয় বিয়েটা করতে।
সুমি বলে চলে, ‘বুঝলি ছোট ভাইয়া, কয়েক দিন পর দেখি সামিনা আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা। আমি তো চিনতে পারিনি। সে-ই সালাম দিয়ে দাঁড়াল, তখন চিনলাম। বললাম আরে সামিনা, তোমাকে তো চেনারই উপায় নেই। হঠাৎ এই পরিবর্তন? লাজুক হেসে বলল, ‘আপা ও বলেছে বোরকা পরে চলাফেরা করতে। আর আপা, আমি গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছি।’