স্থাপত্যশিল্পের অদ্ভুত সুন্দর কিছু উদাহরণ হল মাইমেটিক ভবন। কোন কিছুর অনুকরণে তৈরি করা হয় বলেই এই ভবন বা বিল্ডিংগুলোকে মাইমেটিক ভবন বা মাইমেটিক বিল্ডিং বলা হয়। মাইমেটিক বিল্ডিং নিয়ে করা প্রবাস মেলা’র ধারাবাহিক প্রতিবেদনের এবারের পর্বে আপনাদের জানাবো যুক্তরাষ্ট্রের ‘পিরামিড’ সম্পর্কে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডার শহর লাস ভেগাসের দক্ষিণাংশে লাস ভেগাস স্ট্রিপ ধরে চলতে গিয়ে হঠাৎ করেই যদি চোখে পড়ে পিরামিড আর সেই পৌরাণিক সৃষ্টি স্ফিংস এর মূর্তি তাহলে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আপনি থমকে যেতেই পারেন। ‘মিশরের পিরামিড যুক্তরাষ্ট্রে! কিভাবে সম্ভব?’ এই ভাবনায় পড়ে এক সেকেন্ডের জন্য ভাবতেই পারেন আপনি আসলেই আমেরিকার নেভাডায় আছেন নাকি মায়াবলে মিশরে পৌঁছে গেছেন! তবে একটু খোঁজ নিলেই আপনি বুঝতে পারবেন কেন পিরামিড মিশর পেরিয়ে লাস ভেগাসে চলে এসেছে। আসলে লাস ভেগাসে যে পিরামিড আছে তা মিশরের পিরামিডের রেপ্লিকা। সামনে দাঁড়ানো স্ফিংসের মূর্তিটিও এক নিখুঁত রেপ্লিকা।
লাস ভেগাস স্ট্রিপ এর দক্ষিণ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা কালোরঙের এই রেপ্লিকা পিরামিডটি MGM Resorts International এর মালিকানাধীন হোটেল এবং ক্যাসিনো। ‘লুক্সর লাস ভেগাস’ নামে সুপরিচিত এই হোটেল এবং ক্যাসিনোর ‘মিশরীয় থিম’ পরিপূর্ণ করতেই পিরামিডের বাইরে তৈরি করা হয়েছে গির্জার বিখ্যাত স্ফিংসের ১১০ ফিট লম্বা রেপ্লিকা। ৯০ দশকের Postmodernist Architecture এর অন্যতম প্রধান নিদর্শন এই মাইমেটিক বিল্ডিংটি তৈরি করেছে Circus Circus Enterprises। পুরো ভবনটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল ১৮ মাস এবং খরচ হয় ৩৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। Reinforced concrete এর উপর ইস্পাতের ফ্রেম দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এর পিরামিড আকৃতি। ৩০ তলা এই ভবনের ফ্লোর স্পেস হচ্ছে ১১,০০০ বর্গমিটার অর্থাৎ ১২০,০০০ স্কয়ার ফিট। পিরামিড আকৃতির হওয়ার কারণে এতে ‘Inclined Elevator’ সিস্টেম করা হয়েছে। এই এলিভেটরগুলো ৩৯ ডিগ্রিতে উপরের দিকে উঠে। এর বিশাল ক্যাসিনোতে ২০০০ এর উপর স্পট মেশিন ছাড়াও আছে ৮৭ টি Table games (ক্যাসিনোতে ব্যবহৃত টেবিল যাতে নানা ধরনের খেলা হয় যেমন Blackjack, Craps, Roulette, Baccarat ইত্যাদি)।
লুক্সর লাস ভেগাসের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে (Ground breaking) শুরু হয় ১৯৯২ সালের মার্চ মাসে। প্রায় ১৮ মাস পর ১৯৯৩ সালের ১৫ অক্টোবর ১০,০০০ অতিথির উপস্থিতিতে তা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। তৎকালীন সময়ে এটি ছিল স্ট্রিপের সবচেয়ে লম্বা বিল্ডিং। শুধু তাই না, বিশ্বের সবেচেয়ে বড় অঃৎরঁস এর মালিকও লুক্সর লাস ভেগাস। উদ্বোধনের পর এর রুম সংখ্যা ছিল ২৫২৬ টি এবং ক্যাসিনোর আয়তন ছিল ১০০,০০০ স্কয়ার ফিট। এছাড়াও মিশরের নীল নদের আদলে এখানেও ছিল নদী ভ্রমণ। মূলত অতিথিদের পিরামিডের বিভিন্ন প্রান্ত এবং ক্যাসিনোর চারপাশের বিভিন্ন প্রাচীন শিল্পকর্ম ঘুরিয়ে দেখানোই ছিল নদী ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য। দর্শকদের আনন্দ দেয়ার জন্য ক্যাসিনোতে তুতানখামেনের সমাধির আদলে তৈরি করা হয়েছিল সমাধির রেপ্লিকা এবং মিউজিয়াম।
১৯৯৩ সালে অতিথিদের জন্য উন্মুক্ত করা হলেও বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয় লুক্সর লাস ভেগাস। ১৯৯৮ সালে ৬৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে আরও ২০০০ রুম তৈরি করা হয় হোটেলটিতে। বর্তমানে এর মোট রুম সংখ্যা ৪৪০৭ টি। ২০০৭ সালে জুলাই মাসে MGM Resorts International মালিক ঘোষণা করে যে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে হোটেলটির ৮০% নতুন করে সংস্কার করা হবে এবং ‘প্রাচীন মিশরীয় থিম’ এর অনেক কিছুই সরিয়ে সেখানে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন লাউঞ্জ, রেস্টুরেন্ট এবং ক্লাব তৈরি করা হবে।
প্রাচীন পিরামিড আকৃতির হলেও আধুনিক সুযোগ সুবিধার কোন কমতি নেই আমেরিকার ‘লুক্সরের’। অতিথিদের জন্য এখানে আছে ২০,০০০ স্কয়ার ফিট কনভেনশন স্পেস, ৪ টি সুইমিংপুল, একটি ডবফফরহম ঈযধঢ়বষ, স্পা এবং স্যালন আর ২৯ টি রিটেইল স্টোর। এছাড়াও অতিথিদের আনন্দ দেয়ার আছে Blue Man Group এর পারফরমেন্স, বিখ্যাত কমেডিয়ান Carrot Top এর শো, নাইটক্লাব সহ নানা আয়োজন। দর্শকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে ‘Titanic: The Artifact Exhibition’ এবং ‘Bodies: The Exhibition,- an educational display on the human body’
লুক্সর বীম (Lxuor SKy Beam) পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী আলোকরশ্মি। ৪২.৩ বিলিয়ন ক্যান্ডেলার (candela) এই রশ্মির জন্য ব্যবহৃত হয়েছে বাঁকা আয়না (Curved mirror) এবং ৩৯ টি Xenon lamp। মেঘমুক্ত রাতের আকাশে ২৭৫ মাইল দূর থেকেও এই আলো দেখা যায়।
লুক্সর লাস ভেগাস হোটেলের পিরামিডটি মিশরের Red Piramid এবং Bent Piramid এর সমান। বর্তমানে উচ্চতার দিক থেকে এই পিরামিডটি আমেরিকার সবচেয়ে বড় এবং সমগ্রবিশ্বে চতুর্থ স্থানে আছে। এটি লাস ভেগাসের তৃতীয় এবং বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম হোটেল।