নতুন বিশ্বব্যবস্থায় সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রভাবশালী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। চীন, রাশিয়ার মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো আমিরাতকে কাছে চায়। কিন্তু দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন? দুবাইয়ের রাজপরিবারের নারীরা কতটা স্বাধীন? লিখেছেন তৃষা বড়ুয়া
রাজকুমারী লতিফা
দ্য নিউ ইয়র্কার নামে যুক্তরাষ্ট্রের সাপ্তাহিক পত্রিকায় সম্প্রতি একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন ছাপা হয়, যা অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। প্রতিবেদনটি লতিফা বিনত মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুমকে নিয়ে। তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুমের মেয়ে। দ্য নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় ওই প্রতিবেদন লিখেছেন হাইডি ব্লেইক। দুবাইয়ের পলাতক রাজকুমারী শিরোনামে লেখা প্রতিবেদনে ব্লেইক লতিফার গল্প, বাবার বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহ, দুবাই থেকে পালানোর চেষ্টা, অপহরণ ও বন্দিত্ব নিয়ে বিস্তারিত লেখেন।
লেখাটি পড়লে লৈঙ্গিক সমতা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দৃষ্টিভঙ্গি ও দুবাইয়ের আমির শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুমের ‘আধুনিক চিন্তাভাবনার’ ছাপ পাওয়া যায়। ব্লেইক মনে করেন, লতিফা একা নন, দুবাইয়ের রাজপরিবারের অন্য নারীদেরও তার মতোই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অথচ এই নারীদের কী নেই? সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেওয়া এই নারীরা বড় হয়েছেন অঢেল বিত্ত-বৈভবের মধ্যে। লন্ডনের অভিজাত শ্রেণিতে তাদের বিচরণ। তাদের যা নেই তা হলো স্বাধীনতা। নিজেদের মতো করে কিছু করার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত তারা।
জীবন নিয়ে তারা অনেক স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু সেসব স্বপ্ন কখনো বাস্তবে রূপ নিতে পারে না। রাজপ্রাসাদের চৌকাঠ পেরোনোর অনুমতি তাদের নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দুবাইয়ের আমির শেখ মোহাম্মদের অবাধ্য তারা কখনোই হতে পারেন না। লতিফাকে দুই বছর দেখভাল করা এক নার্স ওই প্রতিবেদনে বলেন, ‘কেউ যদি তার পারিবারিক নিয়ম-কানুন ভাঙে, তাহলে তার ভবিষ্যৎ খুব একটা সুখকর হয় না।’ লতিফা আমিরাতের রাজপ্রাসাদকে খাঁচা মনে করেছিলেন। সেখান থেকে তিনি পালানোর চেষ্টা করেন। তার আগে তার বোন শামসা একই চেষ্টা করেছিলেন। লতিফা জানান, ধরা পড়ার পর শামসাকে বেশ কয়েক বছর বন্দি করে রাখা হয়। সে সময় তিনি কয়েকবার আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন।
শেখ মোহাম্মদের সঙ্গে আপস করে লতিফা এখন দুবাইয়ে আছেন বলে ধারণা করা হয়। তিনি দ্য নিউ ইয়র্কারের ওই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেননি। প্রতিবেদনটিতে তার পুরনো ভিডিও ব্যবহার করা হয়। সেসব ভিডিওতে লতিফাকে কথা বলতে দেখা যায়। প্রতিবেদনে লতিফার চাচি বুচরা, যিনি কিশোর বয়সে ৩০ বছরের বড় শেখ মোহাম্মদের বড় ভাইকে বিয়ে করেন, তার কথাও আছে। দুবাইয়ের রাজপরিবারের কঠোর নিয়ম-কানুনের সঙ্গে বুচরা কখনো মানিয়ে নিতে পারেননি। প্রতিবাদ করেছিলেন। এর সাজা তাকে পেতে হয়। তাকে হত্যা করা হয়। বুচরাকে হত্যার নির্দেশদাতা স্বয়ং শেখ মোহাম্মদ। এমনটাই ধারণা সবার। কারণ রাজপরিবারের কোনো সদস্যকে হত্যার নির্দেশ আমির ব্যতীত আর কারও দেওয়ার এখতিয়ার নেই।
লতিফা কে
লতিফার বাবা শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম দুবাইয়ের ধনকুবেরদের একজন। আবাসন ব্যবসায় বিনিয়োগ করে এখন তিনি বিপুল সম্পদের মালিক। তাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দুবাইকে আকর্ষণীয় ব্যবসায়িক কেন্দ্রে পরিণত করার জন্য শেখ মোহাম্মদের ভূমিকা অপরিসীম। একই সঙ্গে তিনি দুবাইয়ের পর্যটনশিল্পেরও ব্যাপক বিকাশ ঘটান। প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। আমিরাতের ক্ষমতায় বসার আগে ইংল্যান্ডে কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলেন শেখ মোহাম্মদ। ১৯৮৫ সালে রাজকুমারী লতিফা জন্মগ্রহণ করেন।
তার মায়ের নাম হুরিয়াহ আহমেদ আল মাশ। ‘লতিফাকে মুক্ত কর’ প্রচারণা থেকে জানা যায়, ২০০২ সালে দুবাইয়ের রাজপ্রাসাদ থেকে পালিয়ে যান ১৬ বছর বয়সী লতিফা। অবশ্য বেশিক্ষণ পালিয়ে থাকতে পারেননি তিনি। খুব সহজে ধরা পড়েন এবং তাকে রাজপ্রাসাদে ফিরিয়ে আনা হয়। তার বাবা শেখ মোহাম্মদ তাকে তিন বছর আটকে রাখেন বলে অভিযোগ আছে। ২০১৮ সালে লতিফা দ্বিতীয়বারের মতো পালানোর চেষ্টা করেন। রাজপ্রাসাদ থেকে পালিয়ে তিনি দুবাইয়ের এক কফি শপে বন্ধু জাউহিয়ানেনের সঙ্গে দেখা করেন।
বন্ধুর সঙ্গে গাড়িতে করে দুবাই শহর থেকে বের হয়ে তিনি সীমান্ত পার হয়ে ওমানে ঢোকেন। সেখান থেকে তারা এক নৌকায় করে আন্তর্জাতিক নদীপথে প্রবেশ করেন। ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় গোয়া উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে লতিফা ও জাউহিয়ানেনকে বহনকারী নৌকা আটক করে ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সেনাবাহিনী। পরে তাদের সেখান থেকে দুবাইয়ে ফিরিয়ে আনা হয়। অবশ্য লতিফার পলায়ন নিয়ে দ্য নিউ ইয়র্কারের প্রতিবেদন ‘লতিফাকে মুক্ত কর’ প্রচারণা থেকে ভিন্ন ও বিস্তারিত।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ২০০২ সালে লতিফা বাবার কাছ থেকে পালিয়ে ওমানে চলে যেতে চেয়েছিলেন। উদ্দেশ্য, সেখানে গিয়ে আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করে বড় বোন শামসাকে মুক্ত করবেন, যাকে সে সময় বন্দি করে রেখেছিলেন শেখ মোহাম্মদ। ওমানে যাওয়ার আগেই তিনি ধরা পড়েন এবং তার বাবার লোকেরা তাকে মারধর করে। কারাগারে তিন বছর বন্দি থাকার পর তাকে মুক্ত করা হলেও সর্বক্ষণ নজরদারির মধ্যে তাকে রাখা হতো। লতিফা কোথায়, কার কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন এসব কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হতো। অবশ্য এত কিছুর পরও লতিফাকে দমানো যায়নি।
তিনি দুবাইয়ের রাজপ্রাসাদ থেকে ফের পালানোর পরিকল্পনা করতে থাকেন। এবারের পরিকল্পনা প্রথমবারের মতো কাঁচা ছিল না। কঠোর শরীরচর্চার পাশাপাশি দুবাই থেকে আগেই পালিয়ে যাওয়া এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। ওই পলাতক তাকে কথা দেন, রাজপ্রাসাদ থেকে পালানোয় তিনি সাহায্য করবেন। কয়েক বছর নানা পরিকল্পনা শেষে ২০১৮ সালে মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষক ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু তিনা জাউহিয়ানেনের সঙ্গে দুবাই থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন লতিফা। রাজপ্রাসাদ থেকে ওমান সীমান্তে তিনি পৌঁছান গাড়ির বুটে লুকিয়ে।
সেখানে জাউহিয়ানেন তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ঝড়ো আবহাওয়ার মধ্যে রাবারের ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে তারা দুজন জীর্ণ হয়ে পড়া এক প্রমোদতরিতে পৌঁছান। ওই প্রমোদতরির নাম ছিল নস্ট্রোমো। নস্ট্রোমোতে ওঠার আগে লতিফা বেশ কয়েকটি ভিডিও অনলাইনে ছাড়েন। ওই সব ভিডিওতে তিনি তার বাবা শেখ মোহাম্মদের ব্যাপক সমালোচনা করেন। তার বোন শামসাকে অপহরণ ও আটক এবং চাচি বুচরাকে হত্যার জন্য দুবাইয়ের আমিরকে দায়ী করেন তিনি। তার বাবা যে তাকে অপহরণ ও বন্দি করে রেখেছিলেন, তাও ভিডিওতে বলেন লতিফা। এ ছাড়া তাকে ও তার বোনকে শেখ মোহাম্মদ নির্যাতন করেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি। লতিফার ওই ভিডিওগুলো অনলাইনে দ্রুতই ভাইরাল হয়।
আমিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ
দুবাইয়ের আমির শেখ মোহাম্মদ কমপক্ষে সাতবার বিয়ে করেন। তার স্ত্রীদের একজন ছিলেন জর্ডানের রাজকুমারী হায়া বিনত আল হুসেইন। ২০০৪ সালে তাদের বিয়ে হয়। ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মোহাম্মদ ও হায়ার বিবাহবিচ্ছেদ হয়। বিচ্ছেদের সময় রাজকুমারী হায়া বিনত আল হুসেইন তাদের দুই সন্তানকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যান। ওই ঘটনার পর লন্ডন হাইকোর্টের অধীনে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে আইনি পদক্ষেপ নেন শেখ মোহাম্মদ।
তার দুই সন্তান ২০০৭ সালে জন্মগ্রহণ করা শেখ আল জালিলা বিনত মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম ও ২০১২ সালে জন্ম নেওয়া শেখ জায়েদ বিন মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুমকে যেন দুবাইয়ে পাঠানো হয়, এই ছিল ব্রিটিশ আদালতের কাছে তার চাওয়া। রাজকুমারী হায়া ব্রিটিশ আদালতে আমিরাতের শাসক শেখ মোহাম্মদের বিরুদ্ধে একটি নয়, কয়েকটি অভিযোগ করেন। রাজকুমারী হায়ার দাবি, লতিফার বড় বোন শামসাকে ২০০০ সালে যুক্তরাজ্য থেকে দুবাইয়ে অপহরণের নির্দেশ দেন শেখ মোহাম্মদ। এ সংক্রান্ত গোটা পরিকল্পনা ছিল তার। এ ছাড়া ২০০২ সালের জুন ও ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দুবার লতিফাকে দুবাইয়ে জোর করে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেন আমিরাতের শাসক।
২০০২ সালে লতিফা দুবাই-ওমান সীমান্ত থেকে রাজপ্রাসাদে ফেরত আসেন এবং ২০১৮ সালে ভারতের গোয়া উপকূলের কাছে সশস্ত্র বাহিনী তাকে দুবাইয়ে পাঠায়। বিচারক উভয় পক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য শুনে রায় দেন, ‘সত্য অনুসন্ধান শেষে আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি, জর্ডানের রাজকুমারী হায়ার দুবাইয়ের আমির শেখ মোহাম্মদের বিরুদ্ধে করা সব অভিযোগ সঠিক। কেবল জোরপূর্বক বিয়ে সংশ্লিষ্ট যে অভিযোগ তিনি করেছেন, তার পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’
আজীবন কারাবাস
লতিফার পরিকল্পনা ছিল, নস্ট্রোমোতে করে তিনি ভারত ও শ্রীলঙ্কায় যাবেন। সেখানে জাল পাসপোর্ট করে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা দেবেন এবং সেখানে পৌঁছে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করবেন। লতিফা পালিয়ে গেছেন জানতে পেরে দুবাই কর্র্তৃপক্ষ তাকে হন্যে হয়ে খোঁজে। একপর্যায়ে তারা ভারতের গোয়া উপকূল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে নস্ট্রোমোর অবস্থান জানতে পারে। দ্য নিউ ইয়র্কারের প্রতিবেদনে বলা হয়, মেয়ে গোয়া উপকূলের কাছে আছে জানতে পেরে দুবাইয়ের আমির শেখ মোহাম্মদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কথা বলেন।
লতিফার বিনিময়ে দুবাইয়ের একজন অস্ত্র ব্যবসায়ীকে প্রত্যর্পণে সম্মত হন দুজন। ভারত সরকার এরপর লতিফাকে ধরতে হেলিকপ্টার, নৌকাসহ সশস্ত্র বাহিনীকে গোয়া উপকূলে পাঠায়। দুবাইয়ে শেখ মোহাম্মদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আগে ওই বাহিনী লতিফাকে চেতনানাশক দ্রব্য খাইয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। জাউহিয়ানেনকে এক সপ্তাহ দুবাইয়ে আটকে রাখা হয়। এরপর তাকে ছাড়া হলে তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখানে এখনো লতিফার মুক্তির জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন জাউহিয়ানেন।
দুবাইয়ের রাজপ্রাসাদ থেকে লতিফার বারবার পালাতে চাওয়ার কারণ কী এ প্রশ্ন ইংল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশ ও বৈশ্বিক সংস্থাগুলো শেখ মোহাম্মদকে করতে পারেনি। তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও তারা নেয়নি। বিশ্ব এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতকে মধ্যপ্রাচ্যে আধুনিক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে অথচ দেশটিতে মানুষকে যেভাবে দমন করা হচ্ছে তা দেখেও চোখ ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এমনকি রাজপরিবারের সদস্যরা পর্যন্ত এই দমন-পীড়ন থেকে মুক্ত নয়।
লতিফার বোন শামসা ২০০০ সালে ব্রিটেনে পালিয়ে গিয়ে সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি। তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দুবাইয়ে ফেরত পাঠানো হয়। লতিফার পালানোর খবর আন্তর্জাতিক মহল জেনে যাওয়ার পর জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সাবেক হাইকমিশনার ম্যারি রবিনসন তার সঙ্গে দেখা করেন। রবিনসন পরে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে জানান, লতিফা অস্থির নারী, যিনি ব্যাপক প্রচারিত ভিডিওগুলোর জন্য এখন অনুতপ্ত।