রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০১ পূর্বাহ্ন

আবার বন্ধ হচ্ছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার

  • আপডেট সময় শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৪

দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জন্য বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ২০২১ সালের ১৮ ডিসেম্বরে নতুন সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে সেই বাজার খুলতে সময় লেগেছিল ৩ বছর। ২০২২ সালের আগস্টে দেশটিতে আবারও বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া শুরু হয়। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার সরকার ঘোষণা দিয়েছে, আগামী ৩১ মার্চের পর নতুন করে আর কর্মীর চাহিদাপত্র ইস্যু করবে না তারা। এর আগে ইস্যু করা চাহিদাপত্রে আগামী ৩১ মে পর্যন্ত দেশটিতে প্রবেশ করা যাবে। এরপর আর বিদেশি কোনও কর্মী সে দেশে প্রবেশ করতে পারবেন না।

মালয়েশিয়ার এমন সিদ্ধান্তে সংশয়ে পড়েছে নেপাল, মিয়ানমারসহ বাংলাদেশও। নেপাল ও মিয়ানমার থেকে সরাসরি কর্মী না নেওয়ার কথা বলা হলেও দ্বিধায় আছে বাংলাদেশ। দেশের জনশক্তি ব্যবসায়ীরা এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুন করে সংকট দেখছেন।

মালয়েশিয়ায় বেকার বাংলাদেশিরা

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে ২০২২ সালে আগস্টে কর্মী যাওয়া শুরু হওয়ার পর থেকে এপর্যন্ত ৪ লাখের বেশি বাংলাদেশি সেদেশে গেছেন। শুধু ২০২৩ সালেই বাংলাদেশ থেকে সাড়ে ৩ লাখের বেশি শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছে মালয়েশিয়া। তাদের মধ্যে এখন বেকার, বেতনহীন ও কম বেতনে চাকরি করছেন— এমন কর্মীর সংখ্যা অন্তত এক লাখ।

গত অক্টোবরে মালয়েশিয়া সরকারের দেওয়া তথ্যমতে, দেশটিতে আড়াই লাখ বিদেশি অতিরিক্ত কর্মী অবস্থান করছে। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন জানান, যে পরিমাণ কর্মী নির্দিষ্ট পাঁচটি খাতে প্রয়োজন ছিল, তার তুলনায় এই সংখ্যা বেশ বড়। বিশেষ করে সেবা খাতে অতিরিক্ত কর্মী এসে পড়েছেন। ধারণা করা হয়েছিল, এই খাতে ২০ হাজার বিদেশি কর্মী আসবে, কিন্তু এসেছে ১ লাখ ৪২ হাজারেরও বেশি। এছাড়া ফ্যাক্টরির কাজে ৫০ হাজার কর্মী আসার কথা ছিল, সেখানে প্রায় ২ লাখ কর্মী মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করেছে। অথচ অন্যান্য খাতে যেখানে ৫০ হাজার কর্মী আসার কথা, সেখানে এসেছে প্রায় অর্ধেক। ফলে কাজ না পেয়ে অনেক কর্মী কষ্টকর জীবনযাপন করছেন।

উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ার সরকারের কাছে কর্মীদের কোটার আবেদন করতে হয় দেশটির বিভিন্ন নিয়োগকারী সংস্থাকে। এই কোটার অপব্যবহারের কারণে গত বছরের মার্চে অনুমোদন বন্ধ করে দেয় সেদেশের সরকার। তারা জানায়, কোটা ব্যবস্থার অপব্যবহার করে কোম্পানিগুলো চাকরি দেওয়ার নামে বিভিন্ন দেশের কর্মীদের সে দেশে নিয়েছে।

বেকারদের বিষয়ে ঢাকাকে হাইকমিশনের চিঠি
সাড়ে ৪ লাখ থেকে শুরু করে ৫ লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ায় গিয়ে কর্মীরা কাজ পাচ্ছেন না, এটি এখন নিয়মিত ঘটনা। সম্প্রতি এমন এক কর্মীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নিজের করুণ অবস্থার কথা তুলে ধরে ওই বাংলাদেশি কর্মী বলেন, ‘দালাল আমাদের বিদেশে পাঠিয়েছে, বলছে ভালো কাজ দেবে। এখন এখানে এসে আমাদের বন্দি অবস্থায় রাখা হয়েছে। আমার আব্বা ব্রেইন স্ট্রোক করে প্যারালাইসিস হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। কিন্তু আমি কোনও সাহায্য করতে পারছি না।’

শুধু সাইফুলই নন, তার মতো অন্তত ১০০ বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় পেমবিনান রিকোলার এসডিএন- বিএইচডি নামে একটি কোম্পানিতে বৈধভাবে কাজের উদ্দেশ্যে গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তিন মাস ধরে খাবার, ঘুমানোর জায়গা, এমনকি টয়লেট সংকটের মধ্যে ছিলেন তারা। বিষয়টি সামনে এলে মালয়েশিয়ার সরকার এ ধরনের ঘটনার জন্য দায়ী কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

পেট্রাজেহরা নামের আরেক কোম্পানিকে গত বছরের ৩১ মে দেড় হাজার বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের ব্যাপারে কোটা অনুমোদন দেয় মালয়েশিয়ার সরকার। সেই কোম্পানির অধীনে ৭২৫ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেন কোনও কাজ ছাড়া। চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি পেট্রাজেহরা কোম্পানিতে কাজ না পাওয়া বেকার কর্মীদের বিষয়ে ঢাকায় একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাই কমিশন।

দূতাবাসের ওই প্রতিবেদনে অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়— সরকারের অনুমোদিত চাহিদাপত্রের বিপরীতে ওই কোম্পানিতে আগত ৭২৫ জন কর্মীর চাকরি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষমাণ বাকি ৭৭৫ জন কর্মীকে যেন পাঠানো না হয়। এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে বিএমইটিকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

এর আগেও মালয়েশিয়ার একাধিক কোম্পানিতে গিয়ে কর্মীরা চাকরি না পাওয়ায় পরবর্তী ফ্লাইট স্থগিত করার জন্য ঢাকায় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস।

মালয়েশিয়া সরকারের ‘বিতর্কিত’ সিদ্ধান্ত

গত ১ মার্চ মালয়েশিয়া সরকার ঘোষণা দিয়েছে— ৩১ মার্চের পর কর্মী নিয়োগে আর ‘কলিং ভিসা’ ইস্যু করা হবে না। ইস্যুকৃত কলিং ভিসার বিপরীতে এবং অনুমোদিত চাহিদাপত্রের কর্মীরা ৩১ মে পর্যন্ত সে দেশে প্রবেশ করতে পারবেন। ১ জুন থেকে নতুন করে ডিমান্ড ইস্যু, কর্মী প্রবেশের বিষয়ে খোলাসা করেনি দেশটির সরকার। তবে বাংলাদেশের জনশক্তি ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত এক বছর ধরে নতুন চাহিদাপত্র দিচ্ছে না মালয়েশিয়া।

গত ৮ মার্চ মালয়েশিয়ান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুশন ইসমাইল ঘোষণা করেন, এজেন্সিগুলো যদি ৩১ মার্চের মধ্যে তাদের কলিং ভিসা প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হয়, তবে বাংলাদেশ থেকে কর্মীদের জন্য সব ধরনের সক্রিয় নিয়োগ কোটা বাতিল হয়ে যাবে।

নতুন সিদ্ধান্তের নেপথ্যে

মালয়েশিয়ান সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে শ্রমবাজার বন্ধের নেপথ্যে ছিল দুর্নীতি। এরপর মালয়েশিয়া সরকার ওিই বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে দেশটিতে কর্মী নিয়োগের ‘এসপিপিএ’ সিস্টেম বাতিল করে দেয়। এরপর নতুন একটি অনলাইন সিস্টেম তৈরি করে— যার নাম ‘এফডব্লিউসিএমএস’। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বাংলাদেশের ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে কর্মী নিয়োগের জন্য নিযুক্ত করে। মালয়েশিয়ান সরকারের পক্ষ থেকে ‘সিনারফ্লেক্স’ নামে একটি কোম্পানিকে পুরো বিষয়টির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সিনারফ্লেক্স কোম্পানির সঙ্গে সেই চুক্তি বাতিল করে আবার বেস্টিনেট নামে একটি কোম্পানির কাছে ‘এফডব্লিউসিএমএস’ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিক একই। বাংলা ট্রিবিউনকে একটি সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের চুক্তি অনুযায়ী—বেস্টিনেটের সঙ্গে ছয় বছরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৩১ মে।

এক বছরেরও বেশি সময় আগে মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশন সেদেশে বিদেশি কর্মী নিয়োগে বিভিন্ন কোম্পানি এবং সরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সন্দেহ করে। তারই অংশ হিসেবে বেস্টিনেটের অফিসে অভিযান চালানো হয়।

২০১৮ সালের ‘এসপিপিএ’ সিস্টেম বাতিলের পর নতুন সিস্টেম তৈরি করে কর্মী নিয়োগে লেগেছিল তিন বছর। এ কারণে দেশটিতে তখন কর্মী যাওয়া বন্ধ ছিল।

কী বলছে অন্যান্য ‘সোর্স কান্ট্রি’

মালয়েশিয়ায় নেপাল দূতাবাস তাদের সরকারকে জানিয়েছে, ৩১ মে’র পর মালয়েশিয়ায় কোনও কর্মী প্রবেশ করতে পারবেন না। অপরদিকে মিয়ানমার ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি ফেডারেশনের (এমওইএএফ) সাধারণ সম্পাদক ইউ মিয়াত থু সিএনআই নিউজকে বলেছেন, নতুন শ্রমিক নিয়োগের প্রয়োজন না থাকায় তারা অভিবাসী শ্রমিকদের প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে।

বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রা’র মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মালয়েশিয়া অনেকদিন ধরেই নতুন ডিমান্ড দিচ্ছে না। এই ঘোষণা সবার মধ্যেই সংশয় তৈরি করেছে। তারা কী করতে চায় তা স্পষ্ট নয়। তাই আমরা সবাই অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য

মঙ্গলবার (১২ মার্চ) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত হাজনাহ মো. হাশিম। বৈঠক শেষে ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের পরিস্থিতি, বিনিয়োগ, সহজভাবে প্রবেশ করাসহ সামগ্রিক বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।

বৈঠক শেষে রাষ্ট্রদূত মো. হাশিম সাংবাদিকদের জানান, দুই প্রান্তে সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়ায় গিয়ে বাংলাদেশি কর্মীরা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। এক থেকে ২ লাখ বাংলাদেশি সম্প্রতি দেশটিতে গিয়ে কাজ না পাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে রাষ্ট্রদূত বলেন, মালয়েশিয়ার সরকার এটাকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। তবে আমরা এটা সমাধানের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com