পাখির মতো আকাশে ওড়ার শখ নেই, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। এই শখ পূরণ করতে চাইলে যেতে পারেন কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের দরিয়ানগর সৈকতে। এখানে ‘প্যারাসেইলিং’–এর মাধ্যমে পাখির মতো আকাশে উড়ে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, সমুদ্রে ট্রলারে মাছ ধরার দৃশ্য, পানিতে গাঙচিলের মাছ শিকার আর পাশের উঁচু পাহাড়ের সারি দেখার দুর্লভ সৌভাগ্য হবে।
কক্সবাজার শহর থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে আট কিলোমিটার গেলে দরিয়ানগর পর্যটনপল্লি। এ পল্লির পশ্চিম পাশেই দরিয়ানগর সমুদ্রসৈকত। মেরিন ড্রাইভ দিয়ে টেকনাফে যাওয়া-আসার সময় আকাশে ভেসে থাকা পর্যটকদের দেখা যায়। আর নিচে বালুচরে দাঁড়িয়ে অন্য পর্যটকেরা শূন্যে ভেসে থাকা ব্যক্তির ছবি তোলেন।
সম্প্রতি দরিয়ানগর সৈকতে গিয়ে দেখা গেল, এক দল পর্যটক প্যারাসেইলিং করার জন্য অপেক্ষা করছেন। তাঁদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। সৈকতে নামার আগে মেরিন ড্রাইভের এক পাশে টিকিট কাউন্টার। টিকিটের মূল্য ২ হাজার ও ২ হাজার ৫০০ টাকা। ২ হাজার টাকার টিকিটে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট আকাশে ওড়া যায়। আর ২ হাজার ৫০০ টাকার টিকিটে আকাশে ওড়ার পাশাপাশি সমুদ্রের লোনাপানিতে দুবার পা ভেজানোর সুযোগ থাকে।
ঢাকার যাত্রাবাড়ির ফখরুল-সাবিহা দম্পতি এসেছেন প্যারাসেইলিং করতে। ইচ্ছা ছিল দুজন একসঙ্গে উড়বেন। কিন্তু প্যারাসেইলিংয়ে একজনই ঝুলতে পারেন। তাই প্রথমে এগিয়ে গেলেন ফখরুল। স্বেচ্ছাসেবীরা ফখরুলের গায়ে প্যারাস্যুট ও লাইফজ্যাকেট পরিয়ে দিলেন। আরেকজন প্যারাস্যুটের লাল রশি বেঁধে দিলেন শরীরে। প্যারাসেইলিং থেকে একটা মোটা রশি টানানো থাকে ৬০০ মিটার দূরে সাগরে ভাসমান স্পিডবোটে।
সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না, সেটা পরীক্ষার পর স্বেচ্ছাসেবী হ্যান্ডমাইকে ওড়ার ঘোষণা দেন। এ সময় বালুচরে দাঁড়িয়ে থাকা পর্যটকদেরও সতর্ক করা হয়। মুহূর্তে স্পিডবোটটি লোনাপানিতে ছুটতে শুরু করে। তখন রশির টান পড়ে প্যারাসেইলিংয়ে। ধীরে ধীরে প্যারাসেইলিং আকাশের পানে উড়তে থাকে।
স্পিডবোটটি কয়েক মিনিটের মধ্যে দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার গভীর সাগরে গিয়ে পৌঁছায়। এরপর প্যারাসেইলিং নিয়ে স্পিডবোটটি আবার ফিরে আসে সৈকতের দিকে। নামার সময়ও হ্যান্ডমাইকে পুনরায় সবাইকে সর্তক করা হয়। মাটিতে পা রেখে হাঁপাতে থাকেন ফখরুল। তারপর সাবিহার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভয়ংকর! তবে দারুণ অভিজ্ঞতা।’
দরিয়ানগরে প্যারাসেইলিং পরিচালনা করছে ‘ফ্লাই এয়ার সি স্পোর্টস প্যারাসেইলিং’ নামের বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের মালিক মোহাম্মদ ফরিদ বলেন, প্রায় দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগে দুই বছর আগে সৈকতে প্যারাসেইলিং চালু করেছেন তিনি। কিন্তু এখনো লাভের মুখ দেখেননি বলে তিনি দাবি করেন। কারণ, প্যারাসেইলিং এখনো সেভাবে পরিচিতি পায়নি।
বর্তমানে তাঁদের চারটি প্যারাসেইলিং, দুটি দ্রুতগতির জলযান জেট স্কি, পাঁচটি স্পিডবোট আছে। সব মিলিয়ে এখানে ৩২ জন কর্মী কাজ করছেন। কর্মীদের বেতন–ভাতা ও মালামাল রক্ষণাবেক্ষণের পেছনে প্রতি মাসে গড়ে চার লাখ টাকা খরচ হয়। বাতাস থাকলে দিনে সর্বোচ্চ ৩০ জন আকাশে ওড়েন।
প্যারাসেইলিং করার সময় অনেকে হাতে মুঠোফোন, চোখে চশমা ব্যবহার করেন। কেউ কেউ মুঠোফোনে সেলফি ও ভিডিও ধারণের চেষ্টা করে থাকেন। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। হাত থেকে ফসকে মুঠোফোন সমুদ্রে পড়ে গেলে ফেরত পাওয়ার সুযোগ নেই।
আবদুল জলিল ও মো. জমির নামের দুই ব্যক্তি প্যারাসেইলিং পরিচালনা করছেন। তাঁরা মালয়েশিয়ার পেনাং সৈকতে ১০-১২ বছর প্যারাসেইলিং প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন।
আবদুল জলিল বলেন, ১২ বছরের নিচে কাউকে প্যারাসেইলিং করতে দেওয়া হয় না। এ ছাড়া ১২০ কেজির বেশি ওজনের মানুষ, দুর্বল চিত্তের মানুষ অথবা হার্টের সমস্যা আছে—এমন লোকজন ছাড়া যেকোনো নারী–পুরুষ নিশ্চিন্তে প্যারাসেইলিং করতে পারেন। তবে যাঁদের উচ্চতায় ভীতি আছে, তাঁদের প্যারাসেইলিং না করাই ভালো।
প্যারাসেইলিংয়ের টিকিট কেনার সময় উড্ডয়নকারীকে কাগজে অঙ্গীকারনামা বা চুক্তিতে সই করতে হয়। চুক্তিতে লেখা থাকে প্যারাসেইলিং করার সময় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেটার দায়দায়িত্ব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নেবে না। অর্থাৎ প্যারাসেইলিং করার সময় নিজের নিরাপত্তার বিষয়ে নিজেকেই সতর্ক থাকতে হয়।
তবে প্যারাসেইলিংয়ে যান্ত্রিক ত্রুটি কিংবা দুর্ঘটনা দেখা দিলে একাধিক জেট স্কি ও স্পিডবোট প্রস্তুত রাখা হয়। গত দুই বছরে এ রকম কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি বলে জানালেন মোহাম্মদ ফরিদ।
এ ছাড়া হিমছড়ি সৈকতের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে আরও দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্যারাসেইলিং করছে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্যারাসেইলিং চলে। বছরের নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত—পাঁচ মাস প্যারাসেইলিং চালু থাকে।
প্যারাসেইলিং করার সময় অনেকে হাতে মুঠোফোন, চোখে চশমা ব্যবহার করেন। কেউ কেউ মুঠোফোনে সেলফি ও ভিডিও ধারণের চেষ্টা করে থাকেন। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। হাত থেকে ফসকে মুঠোফোন সমুদ্রে পড়ে গেলে ফেরত পাওয়ার সুযোগ নেই। তবে আকাশে ওড়ার রোমাঞ্চকর দৃশ্য ধারণ করতে চাইলে বডি মাউন্টেড অ্যাকশন ক্যামেরা ব্যবহার করা যেতে পারে।