বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০১:০৯ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ হলেও গ্রিনল্যান্ড কেন দ্বীপ?

  • আপডেট সময় বুধবার, ২৪ মার্চ, ২০২১

মহাদেশ সম্পর্কে কথা উঠলেই অস্ট্রেলিয়া কেন মহাদেশ এবং গ্রিনল্যান্ড কেন মহাদেশ নয় তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। তবে মূল সমস্যা হলো, মহাদেশের প্রকৃত কোনো সংজ্ঞাও কারো জানা নেই। একধরনের জলভাগকে সাগর বলে, অন্য ধরনকে মহাসাগর, আবার কিছু অংশকে নদী ও খাল বলে। এগুলোকে শনাক্ত করার জন্য যেমন নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা কঠিন, তেমনই মহাদেশকেও শনাক্ত করার মতো সুনির্দিষ্ট কোনো শর্ত ঠিকমতো পাওয়া কষ্টকর। তবুও বিশেষজ্ঞ এবং ভূবিজ্ঞানীদের মত অনুসারে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ঠিক করা হয়, যার সাপেক্ষে একটি মহাদেশকে নির্ধারণ করা সম্ভব।

ভিন্ন ভিন্ন মত থাকার কারণেই মহাদেশ আসলে কয়টি তা নিয়েও রয়েছে মতভেদ। এক দেশে মহাদেশ চারটি কিংবা পাঁচটি ধরা হয়, আবার অন্য দেশে সাতটি। অবশ্য বিশ্বে অধিকাংশ দেশই মহাদেশ সাতটি আছে বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। তবে মহাদেশ পাঁচটি ধরা হোক কিংবা সাতটি; যেকোনো তালিকাতেই অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ হিসেবে গণ্য এবং গ্রিনল্যান্ড কোনো তালিকাতেই মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি।

গ্রিনল্যান্ড; Image source: pulitzercenter.org

মহাদেশ নির্বাচন করার জন্য প্রথমেই স্থলভাগটির আয়তন পর্যবেক্ষণ করা হয়। শুধুমাত্র আয়তনে বড় হলেই হবে না। এর সাথে স্থলভাগটি অবিচ্ছিন্ন এবং মহাসাগর ও সাগরের মাধ্যমে অন্যান্য বৃহৎ স্থলভাগ থেকে আলাদা হতে হবে। যদিও অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের ক্ষুদ্রতম মহাদেশ, তবুও এটি গ্রিনল্যান্ডের তুলনায় শতকরা ৩.৫ ভাগ বড়। অবশ্য গ্রিনল্যান্ড বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ। উল্লেখ্য, অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত ৭.৭৫ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারের একটি ভূখণ্ড। আর গ্রিনল্যান্ড উত্তর মহাসাগর ও উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত ২.১৬ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারে একটি ভূখণ্ড। দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া ষষ্ঠ এবং গ্রিনল্যান্ড দ্বাদশ বৃহত্তম। আর দ্বীপ হিসেবে বিবেচনা করলে অস্ট্রেলিয়ার পরেই গ্রিনল্যান্ডের অবস্থান। কিন্তু অন্যান্য শর্ত পূরণ করতে না পারায় গ্রিনল্যান্ড মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি।

অস্ট্রেলিয়া; Image source: cnbc.com

মহাদেশ হওয়ার জন্য আরো কিছু ভৌগোলিক শর্ত পূরণ করা অত্যাবশকীয়। এর একটি হলো, নিজস্ব টেকটোনিক প্লেটে অবস্থান করা। অস্ট্রেলিয়া এই শর্ত খুব ভালোমতোই পূরণ করেছে। এর নিজস্ব প্লেটের নাম হলো অস্ট্রেলিয়ান প্লেট। অন্যদিকে, গ্রিনল্যান্ড হলো উত্তর আমেরিকান প্লেটে অবস্থিত। আর এই প্লেটের উপর কেবল গ্রিনল্যান্ডই অবস্থিত নয়। এর অংশীদার আরো অনেকে রয়েছে। এই একই প্লেটে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকোও অবস্থান করছে। অর্থাৎ এককভাবে দ্বীপটি কোনো টেকটোনিক প্লেটের ভাগীদার নয়। অবশ্য আলাদা টেকটোনিক প্লেট থাকলেই যে মহাদেশ শনাক্তকরণের কাজ সঠিকভাবে করা যায় ব্যাপারটি কিন্তু সেরকমও নয়। যেমন- ইউরেশিয়ান টেকটোনিক প্লেটের উপর ইউরোপ এবং এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল অবস্থান করছে। পূর্বে উল্লেখিত শর্ত সাপেক্ষে ইউরোপ ও এশিয়া মিলে একটি মহাদেশ হওয়ার কথা। কিন্তু আসল ঘটনা এরকম নয়। এক্ষেত্রে সংস্কৃতি ও জাতিগত বৈচিত্র্যের উপর ভিত্তি করে মহাদেশের বিভাজনটি সম্পন্ন করা হয়।

আবার ভারতের নিজস্ব টেকটোনিক প্লেট থাকা সত্ত্বেও এই দেশটি নিজেই মহাদেশ গঠন না করে এশিয়া মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত। এর পেছনেও সংস্কৃতির বিষয়টি দায়ী। এই মহাদেশটির অনন্য সংস্কৃতির একটি ছোট সংস্করণেরই প্রতিফলন ঘটে ভারতে। ফলে ভারতকে আলাদা করে কোনো মহাদেশ বলা হয় না।

গ্রিনল্যান্ডের মানচিত্র; Image source: operationworld.com

ভৌগোলিক দিক থেকে মূলত উত্তর আমেরিকার অংশ হলেও এই গ্রিনল্যান্ড আবার ডেনমার্ক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। মহাদেশ হতে হলে অবশ্যই একটি ভূখণ্ডকে স্বতন্ত্র হতে হবে। গ্রিনল্যান্ড আসলে সরকারিভাবে ডেনমার্কের অন্তর্ভুক্ত, যদিও এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পরিচালিত হয়। ফলে রাজনৈতিক এবং সংস্কৃতির দিক থেকে দ্বীপটি ইউরোপের অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পক্ষান্তরে, অস্ট্রেলিয়ার স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে সকলেই জানে। এমনকি এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্রিটেনের কমনওয়েলথেরও অন্তর্ভুক্ত।

এক্ষেত্রে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় রয়েছে। গ্রিনল্যান্ডের যেমন নিজস্ব কোনো টেকটোনিক প্লেট নেই, তেমন নির্দিষ্ট কোনো সংস্কৃতিও নেই। বেশিরভাগ সময়ই এর সংস্কৃতির সাথে উত্তর আমেরিকার সংস্কৃতির মিল লক্ষ্য করা যায়। জাতিগত দিক থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, গ্রিনল্যান্ডের শতকরা ৮৯ ভাগ হলো ‘ইনুইট’ বা উত্তর কানাডার স্বদেশী কোনো জাতি। আর বাকি ১১% হলো ডেনমার্কের অধিবাসী। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়ার শতকরা ৯২ ভাগই হলো অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব অধিবাসী। এছাড়া বাকি জনসংখ্যার শতকরা ৭ ভাগ এশিয়ার অধিবাসী এবং শতকরা মাত্র ১ ভাগ আদিবাসীর বাস এই অস্ট্রেলিয়ায় দেখা যায়। আর এ কারণেই গ্রিনল্যান্ডে সংস্কৃতির বৈচিত্র্য দেখা গেলেও অস্ট্রেলিয়ায় তার নিজস্ব সংস্কৃতির ঝলক দেখা যায়। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এই এলাকার সংস্কৃতিতে ও চিন্তাধারায় পাশ্চাত্যের ছাপও লক্ষ্য করা যায়। পুরনো ও নতুনের সংমিশ্রণে অনন্য সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হয় অস্ট্রেলিয়ায়।

অস্ট্রেলিয়ার মানচিত্র; Image source: worldmaps.com

এবার জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে মহাদেশ ও দ্বীপের পার্থক্য নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। ভৌগোলিক কারণগুলো ও সংস্কৃতির বিষয়গুলো শেষ হলে জনসংখ্যা দিয়েই কোনো ভূখণ্ড মহাদেশ কি না তা নিয়ে গবেষণা করা হয়। তবে শুধুমাত্র জনসংখ্যা দিয়ে মহাদেশ বিবেচনা করতে গেলে তা অবশ্যই ভুল হবে। তাছাড়া এদিক থেকে এন্টার্কটিকা মহাদেশের তালিকা থেকে বাদই পড়ে যাবে। তাই সবকিছুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে জনসংখ্যার বিষয়টি আনতে হবে। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে বসবাসরত রয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৮০ হাজার জনগণ। পক্ষান্তরে, গ্রিনল্যান্ডে মাত্র ৫৬ হাজার মানুষ বাস করে। জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ২০৫ তম জনবহুল রাষ্ট্র। এদিক থেকে গ্রিনল্যান্ডকে কোনোভাবেই মহাদেশ বলা সম্ভব নয়।

সিডনি; Image source: lonelyplanet.com

মহাদেশ নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে শহরভিত্তিক একটি আলোচনাও করা যায়। অস্ট্রেলিয়ায় অনেক শহরই দেখা যায়, যেমন- মেলবোর্ন, সিডনি, ক্যানবেরা, নিউ ক্যাসল, পার্থ, ব্রিসবেন ইত্যাদি। এসব শহরে অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যার শতকরা ৮৯ ভাগের বাস রয়েছে। অন্যদিকে, গ্রিনল্যান্ডে প্রধানত একটি শহরই রয়েছে, যার নাম হলো নুক।

নুক শহর; Image source: uniglobelgi.com

শতকরা ৮৪ ভাগ গ্রিনল্যান্ডবাসী শহুরে এলাকায় থাকে। প্রতি ১,০০০ জনে ৬ জন অভিবাসীর আগমন ঘটে অস্ট্রেলিয়ায় এবং প্রতি ১,০০০ জনে ৬ জনের প্রস্থান ঘটে গ্রিনল্যান্ড থেকে। এই মানদণ্ডেও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ হওয়ার শর্ত পূরণ করে, গ্রিনল্যান্ড নয়।

মহাদেশ শনাক্ত করার ক্ষেত্রে বিচিত্র উদ্ভিদকূল ও প্রাণীকূলের উপস্থিতিকেও একটি মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা যায়। অস্ট্রেলিয়ার শতকরা ৮০ ভাগ উদ্ভিদ ও প্রাণীই এককভাবে এই ভূখণ্ডে পাওয়া যায়। অস্ট্রেলিয়ায় ৪,০০০ প্রজাতির মাছ, ১,৭০০ প্রজাতির কোরাল এবং ৫০ প্রজাতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। এর বেশিরভাগের মূল উৎপত্তিস্থলই অস্ট্রেলিয়া। এই তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ক্যাঙ্গারু, ওয়ামব্যাট, তাসমানিয়ান ডেভিল ইত্যাদি।

প্রায় ৫০ মিলিয়ন বছর আগে অস্ট্রেলিয়া এন্টার্কটিকা থেকে আলাদা হয়ে যায়। পরবর্তীতে এই অঞ্চলের আবহাওয়া ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যায়, যা নতুন নতুন উদ্ভিদ ও প্রাণীর আগমনের কারণ বলে অনেকে ধারণা করে। অন্যদিকে, গ্রিনল্যান্ডে ১৫টি অনন্য প্রজাতির উদ্ভিদের দেখা মিললেও প্রাণীগুলো অন্যান্য অঞ্চল, যেমন- কানাডা ও উত্তর আমেরিকাতেও পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে বল্গাহরিণ, মেরু ভাল্লুক, সুমেরু শিয়াল ইত্যাদি।

অস্ট্রেলিয়ার অধিবাসীরা নিজেদেরকে মহাদেশের অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে ভালোবাসলেও গ্রিনল্যান্ডের অধিবাসীরা নিজেদেরকে কোনো মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত না ভেবে দ্বীপের অধিবাসী হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করে। লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, মহাদেশ নির্ধারণ করার জন্য আজ পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা পাওয়া যায়নি। ভূমির আয়তন, জনসংখ্যা, টেকটোনিক প্লেট, শহর, উদ্ভিদ ও প্রাণীকূল, সংস্কৃতির মতো মানদণ্ড বিভিন্ন ভূবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহার করা হয়। তবে মানদণ্ডগুলো সকলের নিকট স্বীকৃত নয়। তবুও এগুলোর মাধ্যমেই এই কাজ করা হয়, কারণ এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এসব নির্ণায়কের মধ্যে প্রায়ই আয়তন ও টেকটোনিক প্লেটের সহায়তায় নির্ধারণ করাকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। আরেকটি ব্যাপার হলো, যে মানদণ্ডের সাপেক্ষেই দেখা হোক না কেন, গ্রিনল্যান্ড কোনোভাবেই মহাদেশের তালিকায় আসে না।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com