টুপ করে নেমে যাওয়া শীতের বিকালে গলির মোড়ের এদিক-সেদিকে তাকালে দেখা মেলে ঘরে ফেরার পথে কর্মব্যস্ত মানুষ রয়েছেন গরম গরম পিঠা নামানোর অপেক্ষায়; দাঁড়িয়ে থাকার ফাঁকেই হয়ত কেউ কেউ নষ্টালজিয়ায় ফেরেন গ্রামে, মায়ের কাছে।
সারি বাধা জলন্ত চুলাকে ঘিরে মানুষের দাঁড়িয়ে থাকার এমন চিত্র পৌষের শেষ বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত নগরজুড়েই চোখে পড়বে।
শুধু যে সড়কের ধারে মাটি কিংবা গ্যাসের চুলা বসিয়ে জোৎস্না বেগম বা আকবর আলীর মতো অসংখ্য বিক্রেতা পিঠা সেঁকছেন তা নয়, তাদের কেউবা টেবিল পেতে কিংবা ভ্যানগাড়িতে চুলা বসিয়ে পিঠা বানাচ্ছেন।
কথায় কথায় জানা গেল, শুধু যে শীতের সময়ে তা কিন্তু নয়; পিঠা বিক্রেতারা বলছেন বছরজুড়েই চলে তাদের বিকিকিনি।
শীতের এ সময়ে বেচাকেনা শুরু হয় বিকেল ৪টার দিকে; চলে রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত। শুধু যে স্বাদ গ্রহণ তা নয়, কর্মব্যস্ত নগরবাসীর অনেকেই সন্ধ্যার নাস্তা হিসেবেও কেনেন পিঠা।
এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা ফিরোজ ইসলামকে যেমন দেখা গেল বাসার জন্য ১০টি পিঠা নিয়ে যেতে, তেমনি অফিসেও বৈকালিক বা সান্ধ্যকালীন নাস্তার তালিকাতেও শীতের পিঠা জায়গা করে নিয়েছে।
মালিবাগ থেকে খিলগাঁও কিংবা এলিফ্যান্ট রোড থেকে বেইলি রোডের মত নগরজুড়ে সব শ্রেণি বা বয়সীদেরই পিঠা খেতে ভিড় করতে দেখা যায়।
কোভিড সংক্রমণের ভয় দূরে রেখেই নানা পদের ভর্তা দিয়ে মজা করে খাচ্ছেন চিতই পিঠা। খেজুরের গুঁড় ও নারিকেল দিয়ে তৈরি ভাপা পিঠার স্বাদও নিচ্ছেন অনেকে।
পিঠা সেঁকে জীবিকা, আছেন মৌসুমী বিক্রেতাও
ছয় বছর ধরে এলিফ্যান্ট রোডের একটি গলিতে ভাপা, চিতই ও ডিমের পিঠা বিক্রি করেন আকবর আলী। তাকে সহায়তা করেন বাবা ও ছোটভাই। প্রতিপিস ভাপা ও চিতই ১০ টাকা এবং ডিমের পিঠা বিক্রি করেন ২০ টাকায়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কাস্টমার ভালোই আসে। লাভও ভালোই হয়। বিকাল ৪টা বাজলে বসি; কাস্টমার যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণই থাকি। অনেক সময় রাতের ১১টাতেও অনেকে আসে পিঠা খাইতে।”
আকবরের দোকানের একটু সামনে চিতই পিঠা বানান জ্যোৎস্না বেগম। স্বামীর সঙ্গে মিলে প্রায় ২৫ বছর ধরে এ কাজ করেই ঢাকায় থাকছেন তারা।
শুধু শীতকালেই নয়, বছরের অন্য সময়েও রাজধানীতে চলে চিতই পিঠা। তাই দীর্ঘ সময় ধরে পিঠার ব্যবসা করেই চলছে জ্যোৎস্নার ছয় সদস্যের পরিবার। তার দোকানে পিঠার সঙ্গে সরিষা, শুটকি, ধনেপাতা আর কাঁচামরিচ- এই চার পদের ভর্তার দেখা মিলল।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর মানুষজন কম আসে জানিয়ে জ্যোৎস্না বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন তবুও দোকান চলে। লাভের টাকা দিয়াই সংসার চালাইতে পারি কোনো রকমে।”
এখান থেকে ১০টি পিঠা পার্সেল নিচ্ছিলেন এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা ফিরোজ ইসলাম। তিনি বলেন, “বাজার করে ফিরছিলাম। ভাবলাম, বাসায় সবার জন্য পিঠা নিয়ে যাই। সন্ধ্যার নাস্তাটা পিঠা দিয়েই হবে।”
হাতিরপুলের মোতালিব প্লাজার নিচে রাস্তার ধারে ভাপা পিঠা বানান মোহাম্মদ মিঠু। শীতকাল এলে এ ব্যবসা করেন গত ১৬ ধরে।
বছরের অন্য সময়ে মৌসুমী ফল, বিশেষ করে আনারস বেচেন তিনি। তার দোকানে আতপ চালের গুড়া ও খেজুঁরের গুড় দিয়ে তৈরি প্রতিটি পিঠা বিক্রি করা হয় ১৫ টাকা করে।
পাঁচ টাকা বেশি কেন- প্রশ্নে মিঠু বলেন, “আমার পিঠার মান অন্যান্য যে কোনো দোকানের চেয়ে ভালো। তাই দামও একটু বেশি।”
সারাদিনে পিঠা বিক্রি করে চারশ থেকে পাঁচশ টাকা লাভ হয় বলে ভাষ্য তার।
খিলগাঁওয়ের গোড়ানে কাছাকাছি দূরত্বে বেশ কয়েকটি পিঠার দোকান। রাস্তার একধারে ভাপা পিঠা নিয়ে বসেছেন মাইদুল ইসলাম। বিকেল গড়ালেও তেমন ক্রেতা দেখা গেল না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সন্ধ্যার পর মানুষ একটু বেশি থাকে। একেকদিন একেকরকম আয় হয়। এক হাজার টাকার পিঠা বিক্রি করলে লাভ হয় চারশ টাকা।”
কাছাকাছি আরেকটি দোকানে মাটির চুলায় চিতই পিঠা বানাচ্ছিলেন হাসি রাণী। তিনি বললেন, “শীতকালে পিঠা বানাই। অন্যান্য সময়ে একটা ঘিয়ের কারখানায় কাজ করি। মাঝে মাঝে আমার ছেলেও দোকানে বসে। সেও ঘিয়ের কারখানায় কাজ করে।”
তবে মহামারীকালে মানুষ কম আসে বলে লাভও কমেছে, বললেন হাসি।
মগবাজার ডাক্তার গলিতে কথা হয় ভাপা পিঠা বিক্রেতা কুড়িগ্রামের রৌমারীর মোহাম্মদ দুলাল হোসেনের সঙ্গে। গত তিন বছর ধরে শীতে রাজধানীতে আসেন ভাপা পিঠা বিক্রি করত। সারা বছর গ্রামে কৃষি কাজ করলেও এ তিন মাস ঢাকায় পিঠা বিক্রি করেন।
এই মৌসুমী বিক্রেতা জানান, প্রতি কেজি আতপ চালের গুঁড়া দিয়ে ২০ থেকে ২৫টি ভাপা পিঠা তৈরি হয়। প্রতিদিন দেড়শটি ভাপা পিঠা বিক্রি করে লাভ হয় পাঁচশ টাকা। প্রতিটি পিঠার দাম নেন ১০ টাকা।
তার মতো তিন মাস ধরে মালিবাগ মোড়ে রাস্তার পাশে চিতই পিঠা বিক্রি করছেন শাহনাজ বেগম। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বাসা বাড়িতে কাজ করা ছেড়ে দিয়ে পিঠার দোকান দিয়েছেন তিনি। স্বামী ও ছেলে বিক্রি করেন হালিম।
শাহনাজ বলেন, “প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা থাকে। তবে কষ্ট লাগে যখন অনেকে দলবেঁধে এসে পিঠা খেয়ে চলে যান; টাকা দেয় না, ভয়ে কিছু কইতেও পারি না।’’
মালিবাগ মোড়ে পিঠা খেতে খেতে মোহাম্মদ শামিম নামে এক গাড়িচালক বলেন, ‘‘ক্ষুধা লেগেছে বলে চিতই পিঠা খাচ্ছি। এটা বিকেলের নাস্তার কাজ করে। গ্রামে যে পিঠা খেতাম সেটার সঙ্গে ঢাকা শহরের পিঠার তুলনা হয় না।”
রাসেল নামে এক চাকরিজীবী বললেন, “একটা খেয়ে ভালো লাগায় আরেকটা খেলাম। স্বাদটা মুখ লেগে থাকায় আরেকটা খেতে মন চায়। সরিষা ভর্তা দিয়ে চিতই ভালো লাগে।”
লালমনিরহাটের হামিদুল ইসলাম আট বছর ধরে চিতই পিঠা বিক্রি করে আসছেন নিউ কাকরাইল রোডের রাস্তার ধারে। তার দোকানে ২৪ রকমের ভর্তা আছে।
কয়েক ধরনের মরিচ ও শুঁটকি ভর্তা ছাড়াও লেবু, কালিজিরা ভর্তঅ ছাড়াও কী নেই তার কাছে। চিতই পিঠাও আছে কয়েক ধরনের। ডিম চিতইয়ের পাশাপাশি সাদা চাপ্টি চিতই। একটি চিতই পিঠা পাতলা করে কেটে মচমচে করে ভাজা পিঠাই সাদা চাপ্টি পিঠা।
শীত-গ্রীষ্ম সব সময়ই চিতই পিঠা বিক্রি করার কথা জানালেন এই বিক্রেতা।
মালিবাগ মোড়ে রিকশা থামিয়ে চিতই পিঠা নিচ্ছিলেন চাকরিজীবী সালমা বেগম। তিনি জানান, বাসায় মেয়ে আছেন। তার জন্য অফিস শেষে পিঠা নিয়ে যাচ্ছেন।