আজ সকালে ঘুম ভেংগেছে জোরালো বৃষ্টির শব্দে। আমার ঘরের লাগোয়া ডেকের ছাদ ফাইবার গ্লাসের। তার উপর ঝুম ঝুম করা বৃষ্টির শব্দ ঠিক টিনের চালের মতোই লাগে। ছুটির দিন। উঠার তাড়া নেই। জানালার পর্দা সরিয়ে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষন বৃষ্টি দেখা যায়। বৃষ্টির শব্দের চেয়ে এতো শান্তির শব্দ কি আর আছে পৃথিবীতে? উত্তর হচ্ছে…না নেই।
ঘরের বাকিরা সবাই ঘুমে। পাতলা একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে।
মাথার কাছে মোবাইল রাখা। ধরার জন্য হাত নিশপিশ করছে। ধরলেই জানি সব শেষ…মহামারীর সময়…কোভিডময় জীবন। মৃত্যু সংবাদ। আক্রান্তের খবর। অসহায়ত্বের সংবাদ। দেশে..দেশে। থাক আরো কিছুক্ষন।
বোষ্টন ম্যারাথনে বোম ব্লাষ্ট হয় ২০১৩ সালে। তিনজন মানুষ মারা যায়। অনেকে আহত হয়। পরে রিসার্চে একটা অবাক করা বিষয় বেরিয়ে আসে। দেখা যায় সেই ম্যারাথনে সেই সময় যারা সশরীরে উপস্থিত ছিল তাদের চেয়ে অনেক বেশি মানসিক সমস্যা (acute stress symptom) তৈরি হয়েছিল যারা ঘণ্টার পর ঘন্টা মিডিয়াতে সেই ভীতিকর দূর্ঘটনার খবর টানা ফলো করেছিল।
এক বছরের বেশি হয়ে গেলো আমারা আমাদের বাস্তব জীবনে দেখতে বসেছি এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ হরর মুভি! প্রতিদিন। চোখ বন্ধ রাখার উপায় নেই। দূর্ভাগ্যক্রমে এইবার আমরা এই ছবির শুধু দর্শক না। মূল পাত্রপাত্রী। ছবি চলছে আমাদের ঘীরেই। ছবি কখন..কিভাবে শেষ হবে তাও জানি না। তাই নিরাপদ দূরত্বের গ্যালারীতে বসে চুপচাপ ছবি দেখার কোন উপায় নেই।
কিন্তু ব্রেক নেয়ার উপায় আছে এবং দরকার আছে। খুব দরকার। লম্বা পথ হাঁটতে চাইলে…লম্বা নদী সাঁতরাতে চাইলে…ধীর ধীরে..থেমে..থেমে পা ফেলা..বা দম নিয়ে নিয়ে স্ট্রোকে নেয়া খুব দরকার। তাই মাঝে মাঝেই ‘কোভিড খবর বিহীন সময়’ ঘোষনা করুন। মনে করুন এই সময়টা অন্য সব কিছুর। বাসায় যখন বসে থাকতে হয় তখন শুধু মিডিয়ায় কোভিডের খবর না নিয়ে অন্য কিছু করুন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ দিনটা আমার গৃহবাস হবে কোভিড খবর মুক্ত থেকে। ছন্দ..তরংগকে জানিয়ে দেব আর আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় বাংলা বইটা আবার পড়বো।
আমি যখন কানাডা আসি…পুরো সংসার তোলার জন্য মাত্র ছয়টা মাঝারি সাইজের ব্যাগই এলাউড ছিল। বই নেয়ারতো প্রশ্নই উঠে না। তাও আমি আমার পছন্দের দ্বিতীয় সেরা বই ‘ফেলুদা সমগ্র’ এনেছিলাম। ফেলুদা আনার কারন হচ্ছে…আমার মনে হয়েছিলো এই বিদেশ বিভুইয়ে বেঁচে থাকার জন্য আমার শক্তি আর সাহস দরকার হবে। ফেলুদা পড়লে আমি সেটা সব সময়ই পাই। মনে হয় আমিই ফেলুদা (নিজেকে নিয়ে আমার আবার একটু বেশিই উচ্চ ধারনা!😃)
কানাডা এসে দেখলাম এখানে চমৎকার বাংলা বইয়ের দোকান আছে। প্রথম সুযোগেই তাই আমি আমার পছন্দের ১ নম্বর সেরা বইটা কিনে ফেললাম।
এই বইটা নিয়ে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে পারি। কিন্তু আমার সেই লম্বা কথা শেষ হবে মাত্র একটা লাইনে……
”বইটা না পড়ে মরে যাবেন না প্লিজ! তাহলে বিরাট ভুল হবে।“
আমি বইটার নাম বলবো না এখন। সেখান থেকে একটু পড়ে শোনাবো।
“….শ্রাবন মাসের মাঝামাঝি সেবার ঘোর বর্ষা নামিল। দিনরাত অবিশ্রান্ত বৃষ্টি, ঘন কাজল-কালো মেঘপুঞ্জে আকাশ ছাইয়াছে; নাঢ়া ও ফুলকিয়া বইহারের দিগন্তরেখা বৃষ্টির ধোয়ায় ঝাঁপসা, মহালিখারূপের পাহাড় মিলাইয়া গিয়াছে – মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেষ্টের শীর্ষদেশ কখনও ঈষৎ অস্পষ্ট দেখা যায়, কখনও যায় না। শুনিলাম পূর্বে কুশী ও দক্ষিণে কারো নদীতে বন্যা আসিয়াছে।“
বিরাট এক বনভুমির অচেনা..অজানা এক জগৎ….তার মানুষ…তাদের বসবাস আপনার সামনে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকবে। একটার পর একটা চরিত্র আসতে থাকবে। আপনি মোহ গ্রস্থের মতো হেঁটে যেতে যেতে চিনতে থাকবেন ভীষণ নিরীহ আর লাজুক রাজু পাঁড়েকে, বারো তের বছরের বালক ধাতুরিয়াকে যে কাছারিতে নাচ দেখানোর জন্য আসে, সুদের কারবারী আবার নির্লোভ-পরোপকারী মহাজন ধাওতাল সাহুকে, ব্রাক্ষ্মণ পণ্ডিত মটুকনাথ…. যূগলপ্রসাদ… কুন্তা… ভেঙ্কটেশ্বর প্রসাদ.. গাঙ্গোতা তরুণী মঞ্চী, রাজা দোবরু পান্না…রাজকন্যা ভানুমতি…নামেই রাজা আর রাজকন্যা…আসলে মাটির ঘর আর পাহাড়ী মানুষদেরই একজন।
আরো কতো চরিত্র…সময়…মুহুর্ত…
এ এক বিরাট জীবন পাল্টে দেয়া জার্নির গল্প… আসলে ছবির পর ছবি। আপনি পড়তে পড়তে খাবারের স্বাদ-বনের গন্ধ..মাটির গন্ধ…ফুলের গন্ধ…বৃষ্টির গন্ধ সবই অপরিবর্তিত ভাবে পাবেন। সাধু ভাষা নিয়েও চিন্তিত হবেন না। কিছুক্ষন পরেই আপনি ভুলে যাবেন গল্পটা সাধু ভাষায় বলা হচ্ছে। প্রমিজ!
যারা পড়েননি তাদের জন্য বলছি উপন্যাসের নাম ‘আরণ্যক’। বিভুতিভুষনের লেখা। তিনি ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ সম্ভবত এই গল্প বলতে পারতেন না।
এবার বলুন…আপনাকে যদি মাত্র একটা বই নিয়ে ‘কোভিড খবর বিহীন দিবস’ কাটাতে বলা হয়…তবে সেটা কোন বই হবে? এবং কেন হবে?
আমারটাতো বলেই দিলাম।