জনশ্রুতি আছে, ‘শিক্ষিত মানুষেরাই পুকুর চুরি করে, অশিক্ষিতদের বড় মাপের চুরির সুযোগ থাকে না।’ কথাটি কানাডার লাইসেন্সধারী ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট বা রেগুলেটেড কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন কনসালটেন্টদের (আরসিআইসি) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
কীভাবে? তা নিয়েই আলোচনা এ লেখায়। সঙ্গে কিছু টিপস দেবো, যাতে অনৈতিক কনসালটেন্ট বা অভিবাসন পরামর্শকদের হাত থেকে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন। দুটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিলে এ লেখার মর্ম বুঝতে সুবিধা হবে।
এক.
কানাডার সাসকাচ্যুয়ান প্রদেশের এক পিএনপি প্রোগ্রামে (প্রভিন্সিয়াল নমিনি প্রোগ্রাম) আবেদন করেছেন এক বাংলাদেশি কোন এক আরসিআইসির সহায়তায়। আবেদনে ভুল তথ্য (ভিত্তিহীন অভিজ্ঞতা সনদ) দেওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় তার এ আবেদন কেবল বাতিলই করা হয়নি, তাকে দুই বছরের জন্য ব্যানড করা হয়েছে। অর্থাৎ, পরবর্তী দুই বছরের জন্য এই আবেদনকারী সাসকাচ্যুয়ান প্রদেশের কোন ইমিগ্রেশন প্রোগ্রামে আবেদন করতে পারবেন না। এ ধরনের অপরাধকে বলে ‘মিসরিপ্রেজেন্টেশন’।
এ অবস্থায় আবেদনকারী তার কনসালটেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভুল তথ্য প্রদান বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইলেন। কনসালটেন্ট সাহেব নিরুত্তর। আবেদনকারীর ইমেইল বা ফোনের জবাব তিনি দিচ্ছেন না। অনেক চেষ্টা-তদবিরের পরও কনসালটেন্টের সঙ্গে যোগাযোগে অক্ষম হয়ে আবেদনকারী তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে কী করা যায় জানতে চাইলেন।
শুরুতেই তাকে বললাম কনসালটেন্টের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির একটা কপি আমাকে পাঠাতে। তিনি তাই করলেন। চুক্তি ঠিক আছে, কিন্তু কনসালটেন্টের স্বাক্ষরের জায়গায় কনসালটেন্ট সাহেব নয়, অন্য কেউ সই করেছেন। সমস্যা এখানেই। এ ধরনের চুক্তিতে কনসালটেন্টের নিজেকেই স্বাক্ষর করতে হয়। এ দায়িত্ব অন্যকে ডেলিগেট করা বেআইনি। আমার ধারণা, ক্লাইয়েন্টের অজ্ঞতার সুযোগে কনসালটেন্ট জেনে বুঝেই এভাবে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ চুক্তি সম্পন্ন করেছেন।
কোন লাভ হবে না জেনেও আবেদনকারীর অনুরোধে কনসালটেন্ট সাহেবের সঙ্গে ফোনে কথা বললাম। তাকে ইমেইল কম্যুনিকেশনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, যে ইমেইল থেকে ওই আবেদনকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে তা তার নয়। কনসালটেন্ট সাহেব আমাকে বললেন, ‘আপনি প্রয়োজনে সিআইসিসি (কলেজ অফ ইমিগ্রেশন অ্যান্ড সিটজেনশিপ কনসালটেন্টস) ওয়েবসাইটে আমার কোন ইমেইল এড্রেস আছে দেখেন।’ সিআইসিসি ওয়েবসাইট তাৎক্ষণিক পরীক্ষা করে দেখলাম, কনসালটেন্ট সাহেব ভুল কিছু বলেননি, ওয়েবসাইটে তার ইমেইল এড্রেস ভিন্ন। কি অবাক কাণ্ড, তাই না!
ওদিকে, আবেদনকারী জোর দিয়ে বললেন, এই লোকই তার কনসালটেন্ট; ঢাকায় তার সঙ্গে একবার মিটিংও হয়েছিল এই কনসালটেন্টের। সার্বিক বিবেচনায় আমার বুঝতে বাকি রইলো না, এই লোকটি নিজের অজ্ঞতার কারণে বুদ্ধিমান কনসালটেন্ট সাহেবের কাছে ঠকেছেন। এ অবস্থায় কনসালটেন্ট সাহেবকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা একপ্রকার অসম্ভব। পাঠকের সুবিধার্থে সিআইসিসি ওয়েবসাইট লিংক এখানে দিলাম যাতে যে কেউ যে কোন আরসিআইসির তথ্য নিমেষেই পেতে পারেন। লিংক: https://college-ic.ca/protecting-the-public/find-an-immigration-consultant
উপরের লিংকে কানাডায় রেজিস্টার্ড কনসালটেন্টদের ইমেইল এড্রেস ও ফোন নম্বর থাকার কথা। কোন কনসালটেন্ট সে তথ্য ওখানে না দিলে তার সেবা গ্রহণ না করাই শ্রেয় মনে করি। এছাড়া, কোন কনসালটেন্টের সঙ্গে ইমেইলে যোগাযোগ হলে দেখে নিতে হবে তিনি সিআইসিসিতে বর্ণিত তার অফিশিয়াল ইমেইল এড্রেসটি ব্যবহার করেছেন কিনা। আপনাদের বুঝার সুবিধার্থে আমি আমার নিজের সিআইসিসি কন্টাক্ট ইনফরমেশনের একটি ইমেজ এ লেখায় যুক্ত করলাম।
‘কলেজ অফ ইমিগ্রেশন অ্যান্ড সিটিজেনশিপ কনসালটেন্টস’ (সিআইসিসি) কানাডার ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট বা আরসিআইসিদের রেগুলেটরি বডি। কোন আরসিআইসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে এ প্রতিষ্ঠান তা খতিয়ে দেখে। দোষী সাব্যস্ত হলে ওই আরসিআইসির লাইসেন্স হারানো, এমনকি জেল জরিমানাও হতে পারে। কানাডায় অন্যসব পেশা- যেমন, শিক্ষকতা, প্রকৌশল, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও নিজ নিজ রেগুলেটরি বডি আছে।
দুই.
দেশ থেকে অপর একজন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন আরেক কনসালটেন্টের অনিয়মের বিষয়ে আলাপ করতে। কনসালটেন্ট এই আবেদনকারীর সঙ্গে (এজেন্টের মাধ্যমে) চুক্তি করেছেন তিরিশ হাজার ডলারে তাকে কানাডায় ওয়ার্ক পারমিটের ব্যবস্থা করে দেবেন বলে। কনসালটেন্ট সাহেব ইতোমধ্যে তার সেই এজেন্ট দিয়ে হাজার দশেক ডলার নিয়েও নিয়েছেন। বছরখানেক অপেক্ষার পরও কাজ না হওয়ায় আবেদনকারী কনসালটেন্ট সাহেবের কাছে টাকা ফেরত চাইলেন। এখানেই ঘটলো বিপত্তি।
আবেদনকারীকে বললাম, যে ইমেইল এড্রেস থেকে আরসিআইসি সাহেবের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে তা আমাকে দিতে। তিনি তা দিলেন। সঙ্গে আরসিআইসি সাহেবের সিআইসিসি রেজিস্ট্রেশন নম্বরও দিলেন। এসব তথ্য দিয়ে সিআইসিসি ওয়েবসাইটে সার্চ দিয়ে দেখলাম সেখানে এই কনসালটেন্ট ইমেইল এড্রেস বা ফোন নম্বর দেননি। ইমেইল এড্রেস মিলে গেলে আবেদনকারীকে বলতাম, এই কনসালটেন্টের বিরুদ্ধে সিআইসিসিতে রিপোর্ট করতে; কিন্তু সে সুযোগ আর হলো কই?
অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, কনসালটেন্টদের একাংশ ইচ্ছে করেই ইমেইল বা ফোন নম্বর সিআইসিসি ওয়েবসাইটে দেন না, বা দিলেও ভিন্ন ইমেইল বা ফোন নম্বর থেকে ক্লাইয়েন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এভাবে তথ্য গোপন বা সঠিক তথ্য ব্যবহার না করার কোন সৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে মনে হয় না।
নিজেকে বাঁচাতে সিআইসিসি ওয়েবসাইটে ইমেইল এড্রেস বা ফোন নম্বর উল্লেখ নেই এমন আরসিআইসিদের এড়িয়ে চলা আপনার কর্তব্য মনে করি। এছাড়া, যেসব আরসিআইসি এসব তথ্য দিয়েছেন তারা ওয়েবসাইটের ইমেইল এড্রেস সত্যিই ব্যবহার করছেন কিনা তাতেও নজর রাখা দরকার। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে শিক্ষিত প্রতারকরা প্রতারণার নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে থাকে নিয়মিত। সেসব প্রতারণা থেকে সুরক্ষা পেতে নিজেকেও প্রশিক্ষিত করে তোলার বিকল্প নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, কিছু অনৈতিক কনসালটেন্টের হাতে নিয়মিতই সেবাগ্রহীতারা ঠকছেন। অথচ, মানুষ কনসালটেন্টের কাছে যায় সুপরামর্শের প্রত্যাশায়।
এ লেখা আর দীর্ঘ না করি। কানাডায় পড়াশোনা বা অভিবাসন বিষয়ে কোনও বিশেষ প্রশ্ন থাকলে আমাকে নিচের ইমেইলে জানাতে পারেন। পরের কোনও লেখায় আপনার আগ্রহের প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস থাকবে। তবে, বর্তমান পর্বসহ এ সিরিজের অন্য পর্বগুলোতে কানাডা ইমিগ্রেশন বিষয়ে যে সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে তা যেন কোনভাবেই আইনি পরামর্শ হিসেবে বিবেচনা করা না হয়। কেননা, সুনির্দিষ্ট আইনি পরামর্শ দেওয়া হয় ব্যক্তিগত সাক্ষাতে, সাধারণ আলোচনায় নয়। অভিবাসন আবেদনের খুঁটিনাটি নিয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোই এ সিরিজের লেখাগুলোর মূল উদ্দেশ্য।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে নিয়মিত চোখ রাখুন কানাডা অভিবাসন নিয়ে আমার নতুন নতুন লেখা পড়তে। ভবিষ্যতে আপনাদের সঙ্গে আরো অনেক মূল্যবান তথ্য সহভাগের প্রত্যাশা রইল।
লেখক: কানাডিয় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট, আরসিআইসি-আইআরবি