বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:০৮ পূর্বাহ্ন

অনলাইন জুয়ার নেশায় সর্বস্বান্ত হচ্ছে মানুষ, পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা

  • আপডেট সময় শনিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বিড়ালক্ষী গ্রামের মাসুদুর রহমান বাপ্পি। ৩৫ বছরের এই যুবক স্থানীয় ফরিজুল নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন অনলাইন জুয়ায়।

এজেন্টের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলে নিয়মিত খেলতেন অনলাইন জুয়া ‘ওয়ানএক্সবেট’।

প্রথমে কয়েকদিন লাভ হলেও পরে হারতেই থাকেন। একপর্যায়ে স্ত্রীর স্বর্ণের চেইন ও আংটি বিক্রি করে জুয়ায় বিনিয়োগ করেন তিনি। তাও রক্ষা করতে পারেনি তাকে। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েন মাসুদুর রহমান বাপ্পি।

শুধু মাসুদুর রহমান বাপ্পি নয়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ও আটুলিয়াসহ উপকূলবর্তী ইউনিয়নগুলোতে ভয়ংকর রূপে বিস্তার লাভ করেছে অনলাইন জুয়া। এতে হাজারো নারী-পুরুষ সর্বস্ব খুইয়ে পথে বসেছে। সেই সাথে পাচার হচ্ছে দেশের অর্থ।

বিপরীতে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলা ‘ওয়ানএক্সবেট’ ‘বাবু৮৮’সহ বিভিন্ন জুয়ার অ্যাপসের বিস্তার ঘটিয়ে কোটিপতি বনে যাচ্ছেন জুয়ার স্থানীয় মাস্টার এজেন্ট ও সাব এজেন্টরা।

এলাকার মানুষকে চুষে কোটিপতি বনে গেলেও অনলাইন জুয়ার মাস্টার এজেন্ট ও সাব এজেন্টরা থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে দেদারসে অনলাইন জুয়ার কারবার চালাচ্ছেন তারা।

অনলাইন জুয়া ছড়িয়ে পড়েছে যেভাবে

শিশু, কিশোর, যুবক, যুবতী সবার হাতেই স্মার্ট ফোন। বাড়ি, হাটে, মাঠে-ঘাটে মোবাইলফোনের স্ক্রিন স্ক্রল করতে দেখা যায় তাদের। কেউ গেমিংয়ে ব্যস্ত, কেউ অনলাইন জুয়ায়। যাদের নিজস্ব স্মার্টফোন নেই, তারাও জড়িয়ে পড়ছেন অনলাইন জুয়ায়। সেক্ষেত্রে স্মার্টফোন ভাড়া নিয়ে জুয়ায় বিনিয়োগ করছেন তারা।

এক্ষেত্রে জুয়াড়িদের অ্যাকাউন্ট খুলে দিতে ও ডলার সরবরাহ করতে গড়ে উঠেছে এজেন্ট সিন্ডিকেট। রয়েছে মাস্টার এজেন্ট ও সাব এজেন্ট। এসব এজেন্টের কাছ থেকে বাংলাদেশি মুদ্রার বিনিময়ে ডলার সংগ্রহ করেন জুয়াড়িরা।

সহজে প্রচুর টাকা উপার্জনের লোভে পড়ে বিভিন্ন বয়সের মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও তরুণেরা অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন। বাদ যাচ্ছে না নারীরাও। জুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে সর্বস্ব হারাতে বসেছেন অনেকে। এ কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি ও দাম্পত্য কলহ।

স্থানীয় এক যুবক শ্যামনগরে অনলাইন জুয়া বিস্তারের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, বায়ু দূষণের মাত্রা নির্ণয় করা হয় যেভাবে, তেমন কোনো পর্যবেক্ষক সার্ভার থাকলে তাতে অনলাইন জুয়ায় গোটা শ্যামনগর বিশেষ করে পদ্মপুকুর ও আটুলিয়া ইউনিয়নের নাম উঠে আসবে সবার আগে।

সাতক্ষীরায় অনলাইন জুয়ায় আসক্ত যুবকেরা

সাতক্ষীরায় অনলাইন জুয়ায় আসক্ত যুবকেরা

এজেন্টদের পোয়াবারো, সর্বস্বান্ত মানুষ, পাচার হচ্ছে দেশের টাকা

অনলাইন জুয়ার কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটিপতি বনে যাচ্ছেন এজেন্টরা। কারণ তারা ডলার সরবরাহের বিনিময়ে কমিশন পেয়ে থাকেন। পুঁজি হারানোর কোনো ভয় নেই তাদের। বিপরীতে স্বল্প সময়ে লাখপতি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর মানুষ একের পর এক বিনিয়োগ করে সর্বস্ব খুইয়ে রাস্তায় বসছেন।

কয়েকজন অনলাইন জুয়াড়ি জানান, স্মার্টফোনে নির্ধারিত কয়েকটি অ্যাপস ডাউনলোড করে অংশ নেওয়া যায় এই জুয়ায়। এর মধ্যে ‘বাবু ৮৮’ ও ‘ওয়ানএক্সবেট’ উল্লেখযোগ্য। বাবু ৮৮ অল্প টাকায় খেলা যায়। এর লেনদেন হয় বিকাশের মাধ্যমে। আর ‘ওয়ানএক্সবেট’- এ রয়েছে ছয় শতাধিক জুয়ার গেম। এতে বিপুল টাকা বিনিয়োগ ও জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলার প্রয়োজন হয় এবং নির্দিষ্ট এজেন্টের মাধ্যমে করতে হয় লেনদেন। এসব জুয়ার গেমের বেশিরভাগই পরিচালিত হচ্ছে রাশিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে। বাংলাদেশে এগুলোর স্থানীয় প্রতিনিধি (এজেন্ট) রয়েছে। মাস্টার এজেন্টরা বিদেশি অ্যাপস পরিচালনাকারীদের কাছ থেকে হাজারে কমপক্ষে ৬০ টাকা কমিশন পান। এতে তারা রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন। আলিশান বাড়ি ও গাড়ির মালিক বনে যাচ্ছেন তারা।

এই লেনদেনের সুযোগ তারা সাব এজেন্টের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেন। এতে তাদের ভাগ্য খুললেও জুয়াড়িরা হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। অপরদিকে এজেন্টের মাধ্যমে জুয়ায় বিনিয়োগ করা টাকা সহজেই পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে।

পদ্মপুকুর ইউনিয়নের খুঁটিকাটা গ্রামের আবুল কাশেম বলেন, অনেক আগে স্থানীয় শাহিনুর নামের এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম এই জুয়া খেলা শুরু করেন। শাহিনুর এই জুয়ার এজেন্টের কাজ করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। বিপরীতে পদ্মপুকুরের হাজারো মানুষ জুয়ায় আসক্ত হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। এজেন্টরা বাদে, যারা খেলে তারা সবাই শেষ।

শ্যামনগরে যাদের হাত ধরে ছড়িয়েছে অনলাইন জুয়া

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, শ্যামনগর উপজেলায় সর্বপ্রথম অনলাইন জুয়ার এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন পদ্মপুকুর ইউনিয়নের খুঁটিকাটা গ্রামের আবু সাঈদের ছেলে শাহিনুর আলম। এরপর এই কাজ শুরু করেন আটুলিয়া ইউনিয়নের কাছারি ব্রিজের হাফিজুর রহমান। আর তাদের থেকেই উপজেলাব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে সহস্রাধিক সাব এজেন্ট।

স্থানীয়দের অভিমত, শ্যামনগর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে পদ্মপুকুর ও আটুলিয়া ইউনিয়নের মানুষ অনলাইন জুয়ায় সবচেয়ে বেশি আসক্ত।

তাদের দেওয়া তথ্য নিয়ে অনুসন্ধানে নামলে পদ্মপুকুর ইউনিয়নে ১৩ জন মাস্টার এজেন্টের নাম উঠে আসে। এরা হলেন, খুঁটিকাটা গ্রামের শাহিনুর রহমান, রাহানুল ইসলাম রাহাত, রহিম, গড়ের মাথা গ্রামের হাবিবুর রহমান, মো. বাবু, পাখিমারা গ্রামের মো. সাগর, হাসানুর রহমান, বাইনতলা গ্রামের মো. আছাবুর, মাসুদ হোসেন, আল আমিন হোসেন, শরিফুল ইসলাম ও রাসেল মাহমুদ। তাদের আওতায় রয়েছে আরও ১১৫ জন সাব এজেন্ট। এদের মধ্যে রয়েছে কয়েকজন নারীও।

আটুলিয়া ইউনিয়নের নওয়াবেকী বাজারে রয়েছে ১০ জন মাস্টার এজেন্ট। এদের মধ্যে কাছারি ব্রিজের হাফিজুর রহমান, নওয়াবেকী বাজারের মাসুদ রানা, আলামিন হোসেন, শাহরিয়া, সাইফুল ইসলাম, রাসেল হোসেন, ফারিজুল ও আবু সাঈদ অন্যতম।

তাদের আওতায় রয়েছে আরও দেড় শতাধিক সাব এজেন্ট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়েই চলছে তাদের জুয়ার কার্যক্রম।

সাব এজেন্ট নেওয়ার ছদ্মবেশে কয়েকজন মাস্টার এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন, আপনি এজেন্ট নেন, পুলিশ কোনো বিষয় না। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মাসিক ভিত্তিতে মাসোহারা দিয়েই চলছে এই খেলা।

এজেন্ট ও সাব এজেন্টদের সাথে কথা বলে যা জানা গেছে

ওয়ানএক্সবেটের মাস্টার এজেন্ট আটুলিয়া ইউনিয়নের কাছারি ব্রিজ গ্রামের হাফিজুর রহমান। সাব এজেন্ট নেওয়ার ছদ্মবেশে তার কাছে পৌঁছান এই প্রতিবেদক। ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ পেয়ে অল্পদিনেই কোটিপতি হওয়ার গল্প শুরু করেন তিনি। বলেন, প্রশাসনকে ম্যানেজ করতে পারলেই বাজিমাত করা যায় ওয়ানএক্সবেটে।

তিনি জানান, টাকা ভরার সময় জুয়াড়িদের কাছ থেকে প্রতি হাজারে ৬০ টাকা হারে কমিশন কাটা হয়। আর টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে হাজারে পঁচিশ টাকা কমিশন কাটা হয়। যা মাস শেষে জুয়ার কোম্পানি এজেন্টদের প্রদান করে। মাস্টার এজেন্টের কাজ হল রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া থেকে অনলাইনের মাধ্যমে ডলার কিনে সেই ডলার সাব এজেন্টের মাধ্যমে জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তিদের গেমিং অ্যাকাউন্টে ভরে দেওয়া।

তার অধীনে কতজন সাব এজেন্ট চলে জানতে চাইলে হাফিজুর রহমান বলেন, আমার মাধ্যমে সাব এজেন্ট হিসেবে মামুনসহ ১০-১২ জন আছে। এ খেলায় এজেন্ট হতে হলে আগে বুঝতে হবে এবং নগদ ক্যাশ টাকা নিয়ে যোগাযোগ করতে হবে। এটা সম্পূর্ণ অবৈধ একটা খেলা। আমাদের চেয়ে মহিলারা এখন বেশি এগিয়ে। তারা এজেন্টের কাজ বেশি করছে।

তিনি বলেন, প্রশাসন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। প্রশাসনের লোকজন আসার আগেই আমরা খবর পেয়ে যাই। মোবাইল ফোন থেকে অ্যাপসগুলো হাইড করে রাখি, ফোন খুঁজলেও যেন না পায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সাব এজেন্ট বলেন, আমরা মূল এজেন্টের হয়ে কাজ করি। আমাদের মাসিক বেতন দিয়ে থাকে। এখন ছাত্র, যুবক ও মধ্যবয়সীরা অনলাইন জুয়ায় বেশি ঝুঁকে পড়েছে। আমরা আজ পর্যন্ত কোনো খেলোয়াড়কে লাভ করতে দেখিনি। প্রথমে দুই একটা গেমে জেতে, এতে লোভ বেড়ে যায়। পরে সব খুইয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে।

অভিভাবক মহলের উদ্বেগ

জুয়ায় আসক্ত পরিবারের অভিভাবক বিড়ালক্ষী গ্রামের বাবু বলেন, আমার ছোট ভাই ওয়ানএক্সবেটে আসক্ত হয়ে টাকা-পয়সা সব নষ্ট করে পরিবারের শান্তি শেষ করে দিয়েছে। কয়েক লাখ টাকা খুইয়ে পথে বসেছে। এজন্য তার বউ তাকে ছেড়ে চলে গেছে। দ্রুততম সময়ে অনলাইন জুয়া রোধ করতে না পারলে যুব সমাজ লোভে পড়লে ধ্বংস হয়ে যাবে।
এজন্য স্থানীয় এজেন্ট ও সাব এজেন্টদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

স্থানীয় মোহাম্মদ মোফাজ্জল হোসেন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, জুয়া মাদকের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বরং এটা আরও ভয়ানক। কারণ, খুব সহজেই এতে আসক্ত হয়ে পড়ছে মানুষ, বিশেষ করে যুবকেরা। জুয়ায় আসক্তদের পরিবারে প্রতিনিয়ত অশান্তি বিরাজ করছে। এজন্য প্রশাসনিকভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুবই জরুরি।

যা বলছে স্থানীয় প্রশাসন

এ প্রসঙ্গে শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. রনি খাতুন বলেন, অনলাইন জুয়ার বিষয়টি উপজেলা আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কমিটির সভায় গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে থানা পুলিশকে এ বিষয়ে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর মোল্লা জানান, ইতোমধ্যে আমরা অনলাইন জুয়াড়িদের ধরতে কার্যক্রম হাতে নিয়েছি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com