দেশে দুই বছর আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযানের মুখে অবৈধ ক্যাসিনো বন্ধ হলেও অনলাইনে জুয়া খেলা থেমে নেই। বিদেশ থেকে পরিচালিত বিভিন্ন সাইটে বিপুল সংখ্যায় আকৃষ্ট হচ্ছে কিশোর-তরুণরা।
ফেসবুক ব্যবহারকারীদের টার্গেট করে এসব সাইটের বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে বাংলায়। অনলাইন ক্যাসিনোর অ্যাপ ইনস্টলের জন্যও দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন অফার। এমনকি বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগোও ব্যবহার করা হচ্ছে।
এসব অ্যাপের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কারিগরি সক্ষমতার অভাব রয়েছে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের। তারা বলছে, বিদেশ থেকে অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালিত হওয়ায় এগুলো ঠেকানো সহজ নয়।
কয়েকটি ক্যাসিনোর ফেসবুক পেজে দেয়া রয়েছে ওয়াটসঅ্যাপ নম্বর। এগুলোতে যোগাযোগ করেও তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বরং টাকার বিনিময়ে গ্রুপের সদস্য হওয়ার শর্ত দেয়া হয়েছে। চাওয়া হয়েছে ভোটার আইডি কার্ড, নাম, বয়স, জন্মতারিখ, মোবাইল ফোন নম্বর। এসব তথ্য দিলেই মেলে গ্রুপের সদস্য হওয়ার অনুমতি।
কীভাবে চলছে জুয়া
অনলাইনে জুয়া খেলেন বা বাজি ধরেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন জুয়ার সাইট ১এক্সবেট। এ ছাড়া বেট৩৬৫ সাইটটিও বেশ জনপ্রিয়। এগুলোর বিজ্ঞাপন নিয়মিত দেয়া হয় ফেসবুকে। দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত এই সাইটগুলোতে ফুটবল, ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলা নিয়ে বাজি ধরা যায়।
এসব সাইট বিদেশ থেকে পরিচালিত হলেও দেশে রয়েছে তাদের এজেন্ট, আর জুয়ার টাকা লেনদেন হয় বিকাশ অথবা নগদে।
অনলাইনে নিয়মিত জুয়া খেলেন এমন একজন নিউজবাংলাকে জানান, এসব সাইট মূলত রাশিয়াকেন্দ্রিক। তবে ভারত ও পাকিস্তান থেকেও এগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়।
তিনি বলেন, ‘এগুলোর অ্যাপ প্লে-স্টোরে সার্চ দিলেই পাওয়া যায়। ইনস্টল করার পর অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। টাকা ঢুকাতে হয় বিকাশ অথবা নগদে। অ্যাপে বিভিন্ন খেলায় জয়-পরাজয় নিয়ে বাজি ধরা যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন গেম আছে, তবে সেটা কম মানুষ খেলে।’
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ-নিউজল্যান্ডের ক্রিকেট খেলা ছিল। অ্যাপে বাংলাদেশ উইন ওয়ান ও নিউজিল্যান্ড উইন টু অপশন থাকে। বাজিতে অংশ নিতে অ্যাকাউন্টে এক হাজার টাকা জমা রাখতে হয়। খেলায় বাংলাদেশের রেটিং ছিল ১.৪৪। অর্থাৎ, বাংলাদেশের হয়ে খেললে এক হাজার টাকায় ৪৪০ টাকা পাওয়া যাবে। জমা রাখা এক হাজার টাকা বাদ দিয়ে পাওয়া যায় ৪৪০ টাকা। অন্যদিকে নিউজল্যান্ডের রেটিং ছিল ২.৪৭। অর্থাৎ নিউজিল্যান্ড জিতলে দলটির পক্ষে বাজি ধরা ব্যক্তি পাবেন ২ হাজার ৪৭০ টাকা। জমা রাখা এক হাজার টাকা বাদ দিয়ে হাতে আসবে এক হাজার ৪৭০ টাকা।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এসব অনলাইন ক্যাসিনো দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হলেও সমন্বয়ের জন্য দেশীয় সিন্ডিকেট রয়েছে। তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ফেসবুক গ্রুপ বা পেজ খুলে প্রচার চালানো হচ্ছে।
এসব অনলাইন ক্যাসিনোর বিজ্ঞাপন শুধু ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ নয়। গুগলে অনুসন্ধান করলে অনলাইন ক্যাসিনোর ওয়েবসাইট বাংলাতেও পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া ক্যাসিনো নিয়ে ইউটিউবে নিয়মিত আপলোড হচ্ছে বাংলা ভিডিও কন্টেন্ট।
বন্ধের কারিগরি সক্ষমতা নেই কর্তৃপক্ষের
সরকার বেশ কিছু সাইট ব্লক করলেও ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করে অনলাইনে চলছে জুয়া খেলা। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আমাদের পক্ষ থেকে যেগুলো বন্ধ করা যায় সেগুলো বন্ধ করেছি। তবে ভিপিএন ব্যবহার করে প্লে-স্টোর থেকে ডাউনলোড করে যেগুলো চালাচ্ছে সেগুলো সব বন্ধ করতে পারছি না।’
কারিগরি সক্ষমতার অভাবের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এটা বাস্তবে পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না। তবে কীভাবে কাস্টমাইজ বা ফিল্টারিং করা যায় সেই চিন্তাভাবনা আমরা করছি।’
ভিপিএন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা সম্ভব নয় জানিয়ে বলেন, ‘এটা যদি বন্ধ করে দিই, তাহলে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষতি হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ইউটিউব, ফেসবুক বা গুগলের সঙ্গে কথা বলি। সবই যে তারা বন্ধ করে তা না। কিছু করে, কিছু করে না। সব ক্ষেত্রে কারিগরি সক্ষমতা তো আমাদের বিটিআরসির নাই। তাহলে টোটাল ভিপিএন অ্যাপসই বন্ধ করে দিতে হবে।
আগের চেয়ে অবস্থার উন্নতি হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘এখন আর আগের মতো চাইলেই বন্ধ করা অ্যাপ্লিকেশনে ঢোকা যাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
এ বিষয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের একটা মনিটরিং টিম রয়েছে, যারা এ বিষয়ে কাজ করছে। যারা অ্যাপ ও জুয়াভিত্তিক বিষয় নিয়ে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করে থাকে।
‘যে ধরনের পেজের মধ্যে এগুলো আসে, আমাদের যে আইন ও নীতিমালা রয়েছে এবং তার সঙ্গে যেগুলো মেলে না, তা আমরা বন্ধ করার জন্য বিটিআরসিকে বলছি; আবার অভিযানও পরিচালনা করছি। অনেককেই ধরেছি এবং মামলাও হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এসব সাইট ও অ্যাপের সঙ্গে বিদেশি চক্র জড়িত। এরা বাংলাদেশে কিছু এজেন্ট নিয়োগ করে, তারা ডিজিটাল কারেন্সি ট্রান্সজেকশন করে থাকে।এভাবে অনলাইনভিত্তিক অ্যাপস এবং ওয়ান টু ওয়ান ইভেন্ট নিয়ন্ত্রণ করা বা নির্মূল করা কঠিন।’
অনলাইন ক্যাসিনোর বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো ব্যবহারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এটা কারা করছে আমরা বের করার চেষ্টা করছি। এ ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় সেটি নিয়েও চিন্তাভাবনা করছি।’