শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৩:০৩ অপরাহ্ন
Uncategorized

আমেরিকা ভ্রমণের পথে

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৬ মার্চ, ২০২১

সময় সুযোগ পেলে তাই বেরিয়ে পড়ি। নিউইয়র্কে থেকে রমজানের ঈদের ছুটিতে ভার্জিনিয়া, ম্যারিল্যান্ড, ওয়াশিংটন ডিসি ট্যুর করলাম। ভার্জিনিয়ার স্প্রিংফিল্ডে আমার বন্ধু-সোনালির বাসায় । ঈদের নামাজের পর খেয়েই আমাদের ভ্রমণ শুরু। চমৎকার রোদ ঝলমলে দিন। ভ্যারাজানো ব্রিজ দিয়ে নিউইয়র্ক ছেড়ে স্ট্যাটেন আইল্যান্ড দিয়ে যেতে যেতে খুব ভালো লাগছিল। নিউইয়র্কের ব্যস্ত রাস্তা আর ব্যস্ত সময় পেছনে ফেলে বেশ খোলামেলা অ্যাপলেশিয়ান মাউন্টেন রেঞ্জের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে তিনটার দিকে আমরা ভার্জিনিয়ায় পৌঁছালাম। সুন্দর ছিমছাম টাউন হাউস সোনালিদের। ব্লকে বাড়িগুলো অনেকটা বাংলাদেশের ক্যান্টনমেন্টের বাড়িগুলোর মতো। সোনালির বর স্বপনদা খুব হাসিখুশি মানুষ। দাদা ঢাকা সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী। প্রচুর খাবার প্রস্তুত করেছে সোনালি। ঈদের দিন বলে কথা। ওদের ছেলে শৌমিক লাজুক খুব।

আর মেয়ে স্বাগতা চটপটে মিশুক। ঢাকায় হলিক্রসে পড়ত। তখন গ্র্যাজুয়েশন করে কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি বিভাগে ইন্টার্নশিপ করছিল। ওর সঙ্গে দেখা হলো না কাজে ছিল তাই। গল্প করে, চা খেয়ে বের হয়ে পড়লাম ওদের বাসা থেকে। সোনালির বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের বাড়ি দেখতে। প্ল্যান্টেশন নিয়ে ওয়াশিংটনের দাদা কাজ শুরু করেছিলেন। সেই ধারা অব্যাহত রেখে পোটোম্যাক নদীর তীরে প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন আর তাঁর স্ত্রী মার্থা চমৎকার এই বৃক্ষগ্রাম গড়ে তোলেন। প্রাসাদটি প্যালাডিয়ান স্টাইলে কাঠের তৈরি। হ্যাম্প চাষের পাশাপাশি তামাক আর গম চাষও হতো।

চমৎকার গ্রাম সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। হ্যাম্প অনেকটা বাংলাদেশের পাটের মতো। এর বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। হ্যাম্প থেকে দড়ি তৈরি হতো, এর আঁশ থেকে কাপড়ও তৈরি হতো। এর বীজ থেকে ড্রাগ ও নেশা দ্রব্য উৎপাদিত হতো। শণের মতো ছাউনিতে এর পাতা ব্যবহৃত হতো। মাছধরার জাল তৈরিতে এর আঁশের সুতো ব্যবহার হতো। এর তেল রং করার কাজে বার্নিশেও ব্যবহার হতো। তাঁর পাঁচটি ফার্মের বিশাল এলাকা জুড়েই চাষ হতো হ্যাম্প।

ব্যস্ত নগর জীবন ছেড়ে এ যেন ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়। মন জুড়িয়ে গেল। ভার্জিনিয়া সৈকতের কাছাকাছি হ্যাম্পটনে ম্যারিয়ট হোটেলের স্যুট বুকিং দেওয়া ছিল। কক্ষে ঢুকে কিছুটা রিলাক্স হয়ে আমরা রাতের খাবার একটা রেস্তোরাঁয় খেয়ে নিলাম। তারপর গেলাম ফিশিং পিয়ারে।
নিশিরাতে বাঁকা চাঁদ আকাশে। সমুদ্রের তুমুল গর্জন শোনা যাচ্ছে। হঠাৎই ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হলো। কালোমেঘ ঢেকে দিল চাঁদ। আমরা তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে গেলাম।

ঘুম ভাঙল অচেনা পাখির ডাকে। চটপট রেডি হয়ে নিচে ডাইনিং হলে গেলাম। সকালের নাশতার বিশাল আয়োজন থেকে পছন্দমতো দু-তিন পদ তুলে নিয়ে বসলাম। এ যেন দাদি বা নানির বাড়ি। ঘুম থেকে উঠে চা বানানোর ঝক্কি ঝামেলা নেই। চা, কফি, সিরিয়াল, স্ক্রাম্বল এগ, টোস্ট, ওয়াফল, সিরাপ, মাফিন, জুস সব সাজানো।

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বাইরে বের হলাম ছবি তুলতে। চেক আউট করে আমরা ছুটলাম সাগরের টানে। বিশালতা নিয়ে আটলান্টিক ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে ভার্জিনিয়ার মাটি। এখানকার বালির রং সাদা। আজ আকাশ নীল, তাই সাগরে ছুটে আসা জলের রংও নীল। ১৩ মাইল দীর্ঘ মনোমুগ্ধকর চমৎকার এই সমুদ্রসৈকত গিনেস বুকে ওয়ার্ল্ড প্লেজার বিচ–এর তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। আর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের সেরা দশের তালিকায় এটি সপ্তম। এতে আমাদের কক্সবাজার আছে দুই নম্বরে। আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর সৈকত। তবে শুনেছি নর্থ ক্যারোলিনার সৈকত সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ঘন্টা দুই সৈকতে কাটিয়ে আমরা ম্যারিল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।

ম্যারিল্যান্ড যেতে নয়নাভিরাম চিজপিক বে ব্রিজ টানেল, যা ২৩ মাইল দীর্ঘ সেটা পার হলাম। দুই দিকে সেতু আর মাঝে টানেল। এর নির্মাণশৈলী দেখে মুগ্ধ, যুগপৎ বিস্মিত। আমেরিকায় এটি দ্বিতীয় দীর্ঘতম সেতু। মাঝপথে যাত্রাবিরতি, সেখানে ইউরোর সেমি ফাইনালে জার্মানি ও ফ্রান্সের খেলা আর লাঞ্চ দুটোই একসঙ্গে উপভোগ করলাম। সন্ধ্যার আগে পৌঁছলাম মেরিল্যান্ডে হ্যাম্পটন বাই হিলটন হোটেলে।

বাচ্চারা সোজা সুইমিং পুলে। সেখানে এক ঘণ্টা কাটিয়ে ফ্রেশ হলে রাতে গেলাম সুনামগঞ্জের বারী চাচার ছোট ছেলে অপুর বাসায়। সেখানে অপুর বড়ভাই ‘আমরা কতিপয় তরুণ সাহিত্যসেবী’র সুদর্শন খসরু ভাইও ছিলেন। এরা দুজনেই গীতিকার ইশতিয়াক রূপুর সহোদর। পোলাও, তান্দুরী চিকেন, ফিসফ্রাই, ভেজিটেবল, মাছের টক, শুঁটকি, সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংস। সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংস যেন অমৃত। চমৎকার রাঁধে অপুর বউ। সুন্দর সময় কাটল স্মৃতিচারণে আর ভোজনে।

এরপর আমরা বেরিয়ে পড়লাম রাতের ন্যাশনাল হারবার আর হোয়াইট হাউস দেখতে। ন্যাশনাল হারবার পোটোম্যাক নদীর তীরে। আলেকজান্দ্রিয়া, মাউন্ট ভারনন আর ওয়াশিংটন ডিসির কেন্দ্রবিন্দুতে। ক্যাপিটল হিল হলো এর অন্যতম আকর্ষণ। ১৮০ ফিট উচ্চতা থেকে দেখা যাবে হোয়াইট হাউস, ক্যাপিটল হাউস, স্মৃতিসৌধ, সিমেটারি আর পোটোম্যাক নদীর সৌন্দর্য।

ম্যারিল্যান্ডের এই সৌন্দর্য দেখে চলে গেলাম হোয়াইট হাউস দেখতে। রাতের হোয়াইট হাউসের মায়াবী সৌন্দর্য দেখে ছবি তুলতে আবার দিনে আসব ঠিক হলো। ফিরলাম হোটেলে। সকাল আটটার দিকে উঠে ব্রেকফাস্ট টেবিলে টিভিতে সংবাদ দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। ডালাসে ৫ পুলিশ নিহত, আহত ১২ পুলিশ। পৃথিবীজুড়ে চলছে হানাহানি। ঢাকার গুলশানে জঙ্গি হামলায় নিহত বিদেশি আর বাংলাদেশিদের জন্য মন ভারাক্রান্তই ছিল।

হোয়াইট হাউসের সামনে চলে গেলাম সকালে। ছবি তুললাম। তারপর ক্যাপিটল হিল, মনুমেন্ট। আরলিংটনে অবস্থিত পেন্টাগন। আমেরিকার প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর। পেন্টাগন দেখলাম।

সবশেষে এয়ার স্পেস মিউজিয়ামে গেলাম। ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই চাঁদের মাটিতে নীল পা রেখে আর্ম স্ট্রং, এডউইন ই অলড্রিন, মাইকেল কলিন্স যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন তার সবকিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করলাম। চন্দ্রযান, চন্দ্রপৃষ্ঠে পতাকা হাতে নভোচারী, চাঁদের মাটিতে যে বাহনে তাঁরা ঘুরে বেড়িয়েছেন। চাঁদের মাটি, একখণ্ড চাঁদ স্পর্শ করে আমি যেন হারিয়ে যাই ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই। নেভিগেশনের আধুনিকায়ন আর রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের আবিষ্কৃত প্লেন। আর আমাদের এই পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যাওয়া সবকিছু আমাকে ভাবায় অনেক।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com